শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
অতএব টীকাকার কখনও যাবান্ কাটিয়া তাবান্, তাবান্ কাটিয়া যাবান্ করিবার অধিকারী নহেন। কিন্তু এখানে টীকাকার ঠিক তাহাই করিয়াছেন। বুঝিবার জন্য শ্লোকের চারিটি চরণে ক্রমান্বয়ে ক, খ, গ, ঘ চিহ্ন দেওয়া যাক। তাহা হইলে শ্লোকস্থ “যাবানের” গায়ে (ক) এবং “তাবানের” গায়ে (গ) চিহ্ন পড়িতেছে।
(ক) যাবানর্থ উদপানে | (গ) তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু |
(খ) সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে | (ঘ) ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ |
তদ্ব্যাখ্যায় টীকাকার করিয়াছেন- | |
(ক) যাবানর্থ উদপানে | (গ) যাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু |
(খ) তাবান্ সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে | (ঘ) তাবান্ ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ |
এক্ষণে পাঠক (গ)তে (গ)তে মিলাইয়া দেখিবেন তাবান্ কাটিয়া যাবান্ হইয়াছে কি না।59
দ্বিতীয় আপত্তি এই যে, ব্যাখ্যার প্রয়োজনমতে ব্যাখ্যাকার যাবান্ তাবান্ বসাইয়া বুঝাইয়া দিতে পারেন। কিন্তু নিষ্প্রয়োজনে বসাইয়া দিতে পারেন কি? যেখানে নূতন যাবান্ তাবান্ না বসাইয়া লইয়া সোজা অর্থ করিলেই অর্থ হয়, সেখানেও কি যাবান্ তাবান্ বসাইয়া লইতে হইবে? এখানে কি নূতন যাবান্ তাবান্ না বসাইলে অর্থ হয় না? হয় বৈ কি। বড় সোজা অর্থই আছে।
যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদোকে
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ ||
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ ||
ইহার সোজা অর্থ আমি এইরূপ বুঝি;-
সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে সতি উদপানে যাবানর্থঃ বিজানতো ব্রাহ্মণস্য সর্ব্বেষু বেদেষু তাবানর্থঃ।
অর্থাৎ সকল স্থান জলে প্লাবিত হইলে উদপানে অর্থাৎ ক্ষুদ্র জলাশয়ে যাবৎ প্রয়োজন, ব্রহ্মজ্ঞ ব্রহ্মনিষ্ঠের সমস্ত বেদে তাবৎ প্রয়োজন।
মহামহোপাধ্যায় প্রাচীন ঋষিতুল্য ভাষ্যকার টীকাকারেরা যে এই সহজ অর্থের প্রতি দৃষ্টি করেন নাই, আমার এরূপ বোধ হয় না। আমার বোধ হয় যে, তাঁহারা এই অর্থের প্রতি বিলক্ষণ দৃষ্টি করিয়াছেন এবং অতিশয় দূরদর্শী দেশকালপাত্রজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়াই এই সহজ অর্থ পরিত্যাগ করিয়াছেন। দুইটা ব্যাখ্যার প্রকৃত তাৎপর্য্য পর্য্যালোচনা করিলেই পাঠক তাহা বুঝিতে পারিবেন। শেষে কথিত এই সহজ ব্যাখ্যার তাৎপর্য্য কি? সর্ব্বত্র জলপ্লাবিত হইলে ক্ষুদ্র জলাশয়ে লোকের আর কি প্রয়োজন থাকে? কোন প্রয়োজনই থাকে না। কেন না, সর্ব্বত্র জলপ্লাবিত-সকল ঠাঁইই জল পাওয়া যায়। ঘরে বসিয়া জল পাইলে কেহ আর বাপী কূপাদিতে যায় না। তেমনি যে ঈশ্বরকে জানিয়াছে, তাহার পক্ষে সমস্ত বেদে আর কিছু মাত্র প্রয়োজন নাই। এখন বেদে কিছু প্রয়োজন নাই, এমন কথা, আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ শিষ্য, আমরা না হয় সাহস করিয়া বলিতে পারি, কিন্তু শঙ্করাচার্য্য, কি শ্রীধর স্বামী এমন কথা কি বলিতে পারিতেন? বেদ স্বয়ম্ভুর, অপৌরুষেয়, নিত্য সর্ব্বফলপ্রদ। প্রাচীন ভারতবর্ষীয়েরা বেদকেই একটা ঈশ্বরস্বরূপ খাড়া করিয়া তুলিয়াছেন। কপিল ঈশ্বর পরিত্যাগ করিতে পারিয়াছিলেন, কিন্তু বেদ পরিত্যাগ করিতে পারেন নাই। বৃহস্পতি বা শাক্যসিংহ প্রভৃতি যাঁহারা বেদ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহারা হিন্দু-সমাজচ্যুত হইয়াছিলেন। অতএব শঙ্করাচার্য্য, কি শ্রীধর স্বামী হইতে এমন উক্তি কখন সম্ভবে না যে, ব্রহ্মজ্ঞানীই হউক বা যেই হউক, কাহারও পক্ষে বেদ নিষ্প্রয়োজনীয়। কাজেই তাঁহাদিগকে এমন একটা অর্থ করিতে হইয়াছে যে, তাহাতে বুঝায় যে, ব্রহ্মজ্ঞানেও যা, বেদেও তা, একই ফল। তাহা হইলে বেদের মর্য্যাদা বাহাল রহিল। শেষে যে ব্যাখ্যা লিখিত হইল, তাহার অর্থ যে, ব্রহ্মজ্ঞানের তুলনায় বেদজ্ঞান অতি তুচ্ছ। এক্ষণে সেই “সর্ব্বেষু বেদেষু” অর্থে “বেদোক্তেষু কর্ম্মসু” “বেদশব্দেনাত্র কর্ম্মকাণ্ডমেব গৃহ্যতে”। ইত্যাদি বাক্য পাঠক স্মরণ করুন। প্রাচীন টীকাকারদিগের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিবেন।
59 সত্য বটে, শঙ্করাচার্য্য তাবান্ শব্দের স্থানে যাবান্ শব্দ ব্যবহার করার বিষয়ে সতর্ক হইয়াছেন, কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে “যদ্” শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। কাজেই এক কথা।