তৃতীয়। আধুনিক ইংরেজি অনুবাদকেরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহাও বুঝাইব। সংক্ষেপতঃ সেই তিন প্রকার ব্যাখ্যা এইঃ-

১ম। সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে উদপানে যাবানর্থঃ বিজানতো ব্রাহ্মণস্য সর্ব্বেষু বেদেষু তাবানর্থঃ। ইংরেজি অনুবাদকেরা এই অর্থ করিয়াছেন। ইহার কোন মানে হয় না।

২য়। সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে সতি উদযাপনে যাবানর্থ ইত্যাদি পূর্ব্ববৎ। এই ব্যাখ্যা নূতন।

৩য়। উপাদানে যাবানর্থঃ সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে তাবানর্থঃ। এবং সর্ব্বেষু বেদেষু যাবানর্থঃ বিজানতো ব্রাহ্মণস্য তাবানর্থঃ। এই অর্থ প্রাচীন এবং প্রচলিত।

অগ্রে প্রচলিত ব্যাখ্যা বুঝাইব। কিন্তু বাঙ্গালা অনুবাদ দেওয়া যায় নাই; তদভাবে যাঁহারা সংস্কৃত না জানেন, তাঁহাদের অসুবিধা হইতে পারে, এ জন্য প্রচলিত ব্যাখ্যার উদাহরণস্বরূপ প্রথমে প্রাচীন অনুবাদক হিতলাল মিশ্র-কৃত অনুবাদ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছিঃ-

“যাহা হইতে জল পান করা যায়, তাহা উদপান শব্দে বাচ্য, অর্থাৎ পুষ্করিণী এবং কূপাদি। তাহাতে স্থিত অল্প জলে একেবারে সমস্ত প্রয়োজন সাধনের অসম্ভব হেতু সেই সেই সমস্ত কূপাদি পরিভ্রমণ করিলে, পৃথক্ পৃথক্ যে প্রকার স্নান পানাদি প্রয়োজন সম্পন্ন হয়, সে সমুদায় প্রয়োজন, সপ্লুতোদকশব্দবাচ্য এক মহাহ্রদে একত্র যেমন নির্ব্বাহ হইতে পারে, তদ্রূপ সমস্ত বেদে কথিত যে কর্ম্মফলরূপ অর্থ, তাহা সমুদায়ই ভগবদ্ভক্তিযুক্ত ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তির তদ্দ্বারাই সম্পন্ন হয়।”

শঙ্কর ও শ্রীধর উভয়েই এইরূপ অর্থ করিয়াছেন, কাজেই আর সকলে সেই পথের পথিক হইয়াছেন। শ্রীধর-কৃত ব্যাখ্যা আমরা উদ্ধৃত করিতেছি।

“উদকং পীয়তে যস্মিংস্তদুদপানং বাপীকূপতড়াগাদি। তস্মিন্ স্বল্পোদকে একত্র কৃৎস্নার্থস্যাসম্ভবাত্তত্র তত্র পরিভ্রমণেন বিভাগশো যাবান্ স্নানপানাদিরর্থঃ প্রয়োজনং ভবতি তাবান্ সর্ব্বোহপ্যর্থঃ সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে মহাহ্রদে একত্রৈব যথা ভবতি এবং যাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু সমস্ত বেদে যাবৎ সর্ব্বোহপি বিজানতো ব্যবসায়াত্মিকাবুদ্ধিযুক্তস্য ব্রাহ্মণস্য ব্রহ্মনিষ্ঠস্য ভবত্যেব।”

ইহার স্থূল তাৎপর্য্য এই যে, যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয় অনেকগুলিন পরিভ্রমণ করিলে যাবৎ পরিমিত প্রয়োজন সম্পন্ন হয়, এই মহাহ্রদেই তাবৎ প্রয়োজন হয়। সেইরূপ সমস্ত বেদে যাবৎ প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, ব্যবসায়াত্মিকা-বুদ্ধি-যুক্ত ব্রহ্মনিষ্ঠায় তাবৎ প্রয়োজন সিদ্ধ হয়।57

আমরা ক্ষুদ্রবুদ্ধি, এই ব্যাখ্যা বুঝিতে গিয়া যে গোলযোগে পড়িয়াছি, প্রাচীন মহামহোপাধ্যায়দিগের পাদপদ্ম বন্দনাপূর্ব্বক আমি তাহা নিবেদন করিতেছি। যে আপনার সন্দেহ ব্যক্ত করিতে সাহস না করে, তাহার কোন জ্ঞানই জন্মে নাই। এবং জন্মিবারও সম্ভাবনাও নাই।

“যাবৎ” “তাবৎ” শব্দ পরিমাণবাচক। কিন্তু কেবল যাবৎ বলিলে কোন পরিমাণ বুঝা যায় না। একটা যাবৎ থাকিলেই তার একটা তাবৎ আছেই। একটা তাবৎ থাকিলেই তার একটা যাবৎ আছেই। এমন অনেক সময়ে ঘটে যে, কেবল “যাবৎ” শব্দটা স্পষ্ট, তাহার পরবর্ত্তী “তাবৎ”কে বুঝিয়া লইতে হয়; যথা-“আমি যাবৎ না আসি, তুমি এখানে থাকিও।” অতএব স্পষ্টই হউক, আর ঊহ্যই হউক, যাবৎ থাকিলেই তাবৎ থাকিবে। তদ্রূপ তাবৎ থাকিলেই যাবৎ থাকিবে।

57 শঙ্করাচার্য্য-ব্যবহৃত ভাষা কিঞ্চিৎ ভিন্ন প্রকার। শ্লোকের দ্বিতীয়ার্দ্ধের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “সর্ব্বেষু বেদেষু বেদোক্তেষু কর্ম্মসু যোহর্থো যৎ কর্ম্মফলং সোহর্থো ব্রাহ্মণস্য সন্ন্যাসিন: পরমার্থতত্ত্বং বিজানতো যোহর্থ: যৎ বিজ্ঞানফলং সর্ব্বত: সংপ্লুতোকস্থানীয়ং তস্মিংস্তাবানেব সংপদ্যতে ইত্যাদি।” ইহার ভিতর অন্য যে কল-কৌশল থাকে, তাহা পশ্চাৎ বুঝাইব। সম্প্রতি “সর্ব্বেষু বেদেষু” ইহার যেরূপ অর্থ ভগবান শঙ্করাচার্য্য করিয়াছেন, তৎপ্রতি পাঠককে মনোযোগ করিতে বলি। “সর্ব্বেষু বেদেষু” অর্থ “বেদোক্তেষু কর্ম্মসু” যে কারণে আনন্দগিরি বলিয়াছেন, “বেদশব্দেনাত্র কর্ম্মকাণ্ডমেব গৃহ্যতে,” সেই কারণে ইনিও বলিয়াছেন, “সর্ব্বেষু বেদেষু” অর্থে “বেদোক্তেষু কর্ম্মসু”।