শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
শ্রীধর স্বামী বলেন, “ত্রিগুণাত্মকাঃ সকামা যে অধিকারিণস্তদ্বিষয়াঃ কর্ম্মফলসম্বন্ধপ্রতিপাদকা বেদাঃ।” এই ব্যাখ্যা অবলম্বনে প্রাচীন বাঙ্গালা অনুবাদক হিতলাল মিশ্র বুঝাইতেছেন যে, “ত্রিগুণাত্মক অর্থাৎ সকাম অধিকারীদিগের নিমিত্তই (!) বেদ সকল কর্ম্মফল সম্বন্ধে প্রতিপাদক হয়েন।” এবং শ্রীধরের বাক্যেরই অনুসরণ করিয়া কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতকার এই শ্লোকার্দ্ধের অনুবাদ করিয়াছেন যে, “বেদসকল সকাম ব্যক্তিদিগের কর্ম্মফলপ্রতিপাদক।” অন্যান্যও সেই পথ অবলম্বন করিয়াছেন।
উভয় ব্যাখ্যা মর্ম্মতঃ এক। সেই ব্যাখ্যা গ্রহণ করিয়া এই শ্লোকের প্রথমার্দ্ধ বুঝিতে চেষ্টা করা যাউক। তাহা হইলেই ইহার অর্থ এই হইতেছে যে, “হে অর্জ্জুন! বেদ সকল সংসারপ্রতিপাদক বা কর্ম্মফলপ্রতিপাদক। তুমি বেদকে অতিক্রম করিয়া সাংসারিক বিষয়ে বা কর্ম্মফল বিষয়ে নিষ্কাম হও।” কথাটা কি হইতেছিল, স্মরণ করিয়া দেখা যাউক। প্রথমে ভগবান্ অর্জ্জুনকে সাংখ্যযোগ বুঝাইয়া, তৎপরে কর্ম্মযোগ বুঝাইবেন অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু কর্ম্মযোগ কি, তাহা এখনও বলেন নাই। কেন না, কর্ম্ম সম্বন্ধে যে একটা গুরুতর সাধারণ ভ্রম প্রচলিত ছিল (এবং এখনও আছে), প্রথমে তাহার নিরাস করা কর্ত্তব্য। নহিলে প্রকৃত কর্ম্ম কি, অর্জ্জুন তাহা বুঝিবেন না। সে সাধারণ ভ্রম এই যে, বেদে যে সকল যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান-প্রথা কথিত ও বিহিত হইয়াছে, তাহাই কর্ম্ম। ভগবান্ বুঝাইতে চাহেন যে, ইহা প্রকৃত কর্ম্ম নহে। বরং যাহারা ইহাতে চিত্তনিবেশ করে, ঈশ্বরারাধনায় তাহাদিগের একাগ্রতা হয় না। এ জন্য কর্ম্মযোগীর পক্ষে উহা কর্ম্ম নহে। এই ৪৫শ শ্লোকে সেই কথাই পুনরুক্ত হইতেছে। ভগবান বলিতেছেন যে, বেদ সকল, যাহারা সংসারী, অর্থাৎ সংসারের সুখ খোঁজে, তাহাদিগের অনুসরণীয়। তুমি সেরূপ সাংসারিক সুখ খুঁজিও না। ত্রৈগুণ্যের অতীত হও।
কি প্রকারে ত্রৈগুণ্যের অতীত হইতে পারা যায়, শ্লোকের দ্বিতীয় অর্দ্ধে তাহা কথিত হইতেছে। ভগবান্ বলিতেছে-তুমি নির্দ্বন্দ্ব হও, নিত্যসত্ত্বস্থ হও, যোগ-ক্ষেম-রহিত হও এবং আত্মবান্ হও। এখন এই কয়টা কথা বুঝিলেই শ্লোক বুঝা হয়।
১। নির্দ্বন্দ্ব-শীতোষ্ণ সুখদুঃখাদিকে দ্বন্দ্ব বলে, তাহা পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। যে সে-সকল তুল্য জ্ঞান করে, সেই নির্দ্বন্দ্ব।
২। নিত্যসত্ত্বস্থ-নিত্য সত্ত্বগুণাশ্রিত।
৩। যোগ-ক্ষেম-রহিত-যাহা অপ্রাপ্ত, তাহার উপার্জ্জনকে যোগ বলে, আর যাহা প্রাপ্ত, তাহার রক্ষণকে ক্ষেম বলে। অর্থাৎ উপার্জ্জন রক্ষা সম্বন্ধে যে চিন্তা, তদ্রহিত হও।
৪। আত্মবান্-অথবা অপ্রমত্ত।56
যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে।
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ || ৪৬ ||
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ || ৪৬ ||
এখানে এই শ্লোকের অনুবাদ দিলাম না। টীকার ভিতরে অনুবাদ পাওয়া যাইবে। কেন না, এই শ্লোকের প্রচলিত যে অর্থ, তাহাতে দুই একটা আপত্তি ঘটে; সে সকলের মীমাংসা না করিয়া অনুবাদ দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নহে।
আমি এই শ্লোকের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা বুঝাইব।
প্রথম। যে ব্যাখ্যাটি পূর্ব্ব হইতে প্রচলিত, এবং শঙ্কর ও শ্রীধরাদির অনুমোদিত, তাহাই অগ্রে বুঝাইব।
দ্বিতীয়। আর একটি নূতন ব্যাখ্যা পাঠকের সমীপে তাঁহার বিচার জন্য উপস্থিত করিব। সঙ্গত বোধ হয়, পাঠক তাহা পরিত্যাগ করিবেন।
56 আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেরূপ মূলসঙ্গত বোধ হইয়াছে, আমি সেইরূপ অর্থ করিলাম। কিন্তু যাঁহারা বেদের গৌরব বজায় রাখিয়া এই শ্লোকের অর্থ করিতে চান, তাঁহারা কিরূপ বুঝেন, তাহার উদাহরণস্বরূপ বাবু কেদারনাথ দত্ত কৃত এই শ্লোকের ব্যাখ্যা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি। পাঠকের যে অর্থ সঙ্গত বোধ হয়, সেই অর্থ গ্রহণ করিবেন।
“শাস্ত্রসমূহের দুই প্রকার বিষয়-অর্থাৎ উদ্দিষ্ট বিষয় ও নির্দ্দিষ্ট বিষয়। যে বিষয়টি যে শাস্ত্রের চরম উদ্দেশ্য, তাহাই তাহার উদ্দিষ্ট বিষয়। যে বিষয়কে নির্দ্দেশ করিয়া উদ্দিষ্ট বিষয়কে লক্ষ্য করে, সেই বিষয়ের নাম নির্দ্দিষ্ট বিষয়। অরুন্ধতী যে স্থলে উদ্দিষ্ট বিষয়, সে স্থলে তাহার নিকটে প্রথমে লক্ষিত যে স্থূল তারা, তাহাই নির্দ্দিষ্ট বিষয় হয়। বেদসমূহ নির্গুণ তত্ত্বকে উদ্দিষ্ট বলিয়া লক্ষ্য করে, কিন্তু নির্গুণ তত্ত্ব সহসা লক্ষিত হয় না বলিয়া প্রথমে কোন সগুণ তত্ত্বকে নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। সেই জন্যই সত্ত্ব, রজ: ও তম রূপ ত্রিগুণময়ী মায়াকেই প্রথম দৃষ্টিক্রমে বেদ সকলের বিষয় বলিয়া বোধ হয়। হে অর্জ্জুন, তুমি সেই নির্দ্দিষ্ট বিষয়ে আবদ্ধ না থাকিয়া নির্গুণতত্ত্বরূপ উদ্দিষ্ট তত্ত্ব লাভ করত: নিস্ত্রৈগুণ্য স্বীকার করে। বেদ শাস্ত্রে কোন স্থলে রজস্তমোগুণাত্মক কর্ম্ম, কোন স্থলে সত্ত্বগুণাত্মক জ্ঞান এবং বিশেষ বিশেষ স্থলে নির্গুণ ভক্তি উপদিষ্ট হইয়াছে। গুণময় মানাপনাদি দ্বন্দ্বভাব হইতে রহিত হইয়া নিত্য সত্ত্ব অর্থাৎ আমার ভক্তগণের সঙ্গ করত: কর্ম্মজ্ঞানমার্গের অনুসন্ধেয় যোগ ও ক্ষেমানুসন্ধান পরিত্যাগপূর্ব্বক বুদ্ধিযোগ সহকারে নিস্ত্রৈগুণ্য লাভ কর।”