ধর্ম্মতত্ত্ব
গুরু। তাহার কারণানুসন্ধান জন্য প্রাচীন গ্রীস ও রোমে যাইতে হইবে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে কোন উন্নত ধর্ম্ম ছিল না, যে পৌত্তলিকতা সুন্দরের এবং শক্তিমানের পূজা মাত্র, তাহার উপর আর কোন উচ্চ ধর্ম্ম ছিল না। জগতের লোক কেন ভালবাসিব ইহার কোন উত্তর ছিল না। এই জন্য তাহাদের প্রীতি কখন দেশকে ছাড়ায় নাই। কিন্তু এই দুই জাতি অতি উন্নতস্বভাব আর্য্যবংশীয় জাতি ছিল; তাহাদের স্বাভাবিক মহত্ত্বগুণে তাহাদের প্রীতি দেশ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়া বড় বেগবতী ও মনোহারিণী হইয়াছিল। দেশবাৎসল্যে এই দুই জাতি পৃথিবীতে বিখ্যাত।
এখন আধুনিক ইউরোপে খ্রীষ্টিয়ান হৌক আর যাই হৌক, ইহার শিক্ষা প্রধানতঃ প্রাচীন গ্রীস ও রোম হইতে। গ্রীস ও রোম ইহার চরিত্রের আদর্শ। সেই আদর্শ আধুনিক ইউরোপে যতটা আধিপত্য করিয়াছে, যীশু তত দূর নহে। আর এক জাতি আধুনিক ইউরোপীয়দিগের শিক্ষা ও চরিত্রের উপর কিছু ফল দিয়াছে। য়িহুদী জাতির কথা বলিতেছি। য়িহুদী জাতিও বিশিষ্টরূপে দেশবৎসল, লোকবৎসল নহে। এই তিন দিকের ত্রিস্রোতে পড়িয়া ইউরোপ দেশবৎসল হইয়া পড়িয়াছে, লোকবৎসল হইতে পারে নাই। অথচ খ্রীষ্টের ধর্ম্ম ইউরোপের ধর্ম্ম। তাহাও বর্ত্তমান। কিন্তু খ্রীষ্টধর্ম্ম এই তিনের সমবায়ের অপেক্ষা ক্ষীণবল বলিয়া কেবল মুখেই রহিয়া গিয়াছে। ইউরোপীয়েরা মুখে লোকবৎসল, অন্তরে ও কার্য্যে দেশবৎসল মাত্র। কথাটা বুঝিলে?
শিষ্য। প্রীতির প্রাকৃতিক বা ইউরোপীয় অনুশীলন কি, তাহা বুঝিলাম। বুঝিলাম, ইহাতে প্রীতির পূর্ণ স্ফূর্ত্তি হয় না। দেশবাৎসল্যে থামিয়া যায়, তার আত্মপ্রীতি আসিয়া আপত্তি উত্থাপিত করে যে জগৎ ভালবাসিব কেন, জগতের সঙ্গে আমার বিশেষ কি সম্পর্ক? এক্ষণে প্রীতির পারমার্থিক বা ভারতবর্ষীয় অনুশীলনের মর্ম্ম কি বলুন।
গুরু। তাহা বুঝিবার আগে ভারতবর্ষীয়ের চক্ষে ঈশ্বর কি, তাহা মনে করিয়া দেখ। খ্রীষ্টীয়ানের ঈশ্বর জগৎ হইতে স্বতন্ত্র। তিনি জগতের ঈশ্বর বটে, কিন্তু যেমন জর্ম্মাণি বা রুষিয়ার রাজা সমস্ত জর্ম্মাণ বা সমস্ত রুষ হইতে একটা পৃথক্ ব্যক্তি, খ্রীষ্টীয়ানের ঈশ্বর তাই। তিনিও পার্থিব রাজার মত পৃথক্ করিযা রাজ্য পালন রাজ্য শাসন করেন, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন, এবং লোকে কি করিল, পুলিসের মত তাহার খবর রাখেন। তাঁহাকে ভালবাসিতে হইলে, পার্থিব রাজাকে ভালবাসিবার জন্য যেমন প্রীতিবৃত্তির বিশেষ বিস্তার করিতে হয়, তেমনই করিতে হয়।
হিন্দুর ঈশ্বর সেরূপ নহেন। তিনি সর্ব্বভূতময়। তিনিই সর্ব্বভূতের অন্তরাত্মা। তিনি জড় জগৎ নহেন, জগৎ হইতে পৃথক, কিন্তু জগৎ তাঁহাতেই আছে। যেমন সূত্রে মণিহার, যেমন আকাশে বায়ু, তেমনি তাঁহাতে জগৎ। কোন মনুষ্য তাঁহা ছাড়া নহে, সকলেই তিনি বিদ্যমান। আমাতে তিনি বিদ্যমান। আমাকে ভালবাসিলে তাঁহাকে ভালবাসিলাম। তাঁহাকে না ভাল বাসিলে আমাকেও ভাল বাসিলাম না। তাঁহাকে ভাল বাসিলে সকল মনুষ্যকেই ভাল বাসিলাম। সকল মনুষ্যকে না ভালবাসিলে, তাঁহাকে ভালবাসা হইল না, আপনাকে ভালবাসা হইল না, অর্থাৎ সমস্ত জগৎ প্রীতির অন্তর্গত না হইলে প্রীতির অস্তিত্বই রহিল না। যতক্ষণ না বুঝিতে পারিব যে, সকল জগৎই আমি, যতক্ষণ না বুঝিব যে, সর্ব্বলোকে আর আমাতে অভেদ, ততক্ষণ আমার জ্ঞান হয় নাই, ধর্ম্ম হয় নাই, ভক্তি হয় নাই, প্রীতি হয় নাই। অতএব জাগতিক প্রীতি হিন্দুধর্ম্মের মূলেই আছে; অচ্ছেদ্য, অভিন্ন, জাগতিক প্রীতি ভিন্ন হিন্দুত্ব নাই। ভগবানের সেই মহাবাক্য পুনরুক্ত করিতেছিঃ-