সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং সর্ব্বভূতানি চাত্মনি।

ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্ব্বত্র সমদর্শনঃ ||

যো মাং পশ্যতি সর্ব্বত্র সর্ব্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।

তস্যাহং ন প্রণশ্যামি সচ মে ন প্রণশ্যতি ||*

“যে যোগযুক্তাত্মা হইয়া সর্ব্বভূতে আপনাকে দেখে আপনাতে সর্ব্বভূতকে দেখে ও সর্ব্বত্র সমান দেখে, যে আমাকে সর্ব্বত্র দেখে, আমাতে সকলকে দেখে, আমি তাহার অদৃশ্য হই না, সেও আমার অদৃশ্য হয় না।”

স্থূল কথা, মনুষ্যে প্রীতি হিন্দু শাস্ত্রের মতে ঈশ্বরে ভক্তির অন্তর্গত; মনুষ্যে প্রীতি ভিন্ন ঈশ্বরে ভক্তি নাই, ভক্তি ও প্রীতি হিন্দুধর্ম্মে অভিন্ন, অভেদ্য, ভক্তিতত্ত্বের ব্যাখ্যাকালে ইহা তাহাতে উহা দেখিয়াছি। প্রহ্লাদকে যখন হিরণ্যকশিপু জিজ্ঞাসা করিলেন যে, শত্রুর সঙ্গে রাজার কিরূপ ব্যবহার করা কর্ত্তব্য, প্রহ্লাদ উত্তর করিলেন, “শত্রু কে? সকলই বিষ্ণু-(ঈশ্বর) ময়, শত্রু মিত্র প্রকারে প্রভেদ করা যায়!” প্রীতিতত্ত্বের এইখানে একশেষ হইল। এবং এই এক কথাতেই সকল ধর্ম্মের উপর হিন্দুধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন হইল বিবেচনা করি। প্রহ্লাদের সেই সকল উক্তি এবং গীতা হইতে যে সকল উক্তি বাক্য উদ্ধৃতি করিয়াছি, তাহা পুনর্ব্বার স্মরণ কর। স্মরণ না হয়, গ্রন্থ হইতে পুনর্ব্বার অধ্যয়ন কর। তদ্ব্যতীত হিন্দুধর্ম্মোক্ত প্রীতিতত্ত্ব বুঝিতে পারিবে না। এই প্রীতি জগতের বন্ধন, এই প্রীতি ভিন্ন জগৎ বন্ধনশূন্য বিশৃঙ্খল জড়পিণ্ড সকলের সমষ্টি মাত্র। প্রীতি না থাকিলে পরস্পর বিদ্বেষপরায়ণ মনুষ্য জগতে বাস করিতে অক্ষম হইত, অনেক কাল হয়ত পৃথিবী মনুষ্যশূন্য, নয় মনুষ্যলোকের অসহ্য নরক হইয়া উঠিত। ভক্তির পর প্রীতির অপেক্ষা উচ্চ বৃত্তি আর নাই। যেমন ঈশ্বরে এই জগৎ গ্রথিত রহিয়াছে, প্রীতিতেও তেমনি জগৎ গ্রথিত রহিয়াছে। ঈশ্বরই প্রীতি, ঈশ্বরই ভক্তি,-বৃত্তি স্বরূপ জগদাধার হইয়া তিনি লোকের হৃদয়ে অবস্থান করেন। অজ্ঞান আমাদিগকে ঈশ্বরকে জানিতে দেয় না এবং অজ্ঞানই আমাদিগকে ভক্তি প্রীতি ভুলাইয়া রাখে। অতএব ভক্তি প্রীতির সম্যক্ অনুশীলন জন্য, জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের সম্যক্ অনুশীলন আবশ্যক। ফলে সকল বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলন ও সামঞ্জস্য ব্যতীত সম্পূর্ণ ধর্ম্ম লাভ হয় না, ইহার প্রমাণ পুনঃ পুনঃ পাইয়াছ।

শিষ্য। এক্ষণে প্রীতিবৃত্তির ভারতবর্ষীয় বা পারমার্থিক অনুশীলনপদ্ধতি বুঝিলাম। জ্ঞানের দ্বারা ঈশ্বরের স্বরূপ বুঝিয়া জগতের সঙ্গে তাঁহার এবং আমার অভিন্নতা ক্রমে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে। ক্রমে সর্ব্বলোককে আপনার মত দেখিতে শিখিলে প্রীতিবৃত্তির পূর্ণ স্ফূর্ত্তি হইবে। ইহার ফলও বুঝিলাম। আত্মপ্রীতি ইহার বিরোধী হইবার সম্ভাবনা নাই-কেন না, সমস্ত জগৎ আত্মময় হইয়া যায়। অতএব ইহার ফল কেবল দেশবাৎসল্য মাত্র হইতে পারে না,-সর্ব্বলোকবাৎসল্যই ইহার ফল। প্রাকৃতিক অনুশীলনের ফল ইউরোপে কেবল দেশবাৎসল্য মাত্র জন্মিয়াছে-কিন্তু ভারতবর্ষে লোকবাৎসল্য জন্মিয়াছে কি?

* এই ধর্ম্ম বৈদিক। বাজসনেয় সংহিতোপনিষদে আছে।
                        যস্তু সর্ব্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি।
                        সর্ব্বভূতেষু, চাত্মানন্ততো ন বিজুগুপ্‌সতে ||
                        যস্মিন্ সর্ব্বাণি ভূতান্যত্মৈভূদ্বিজানত:।
                        তত্র: ক: মোহ: ক: শোক একত্মমনুপশ্যত: ||