শিষ্য। ইউরোপে দেশবাৎসল্যের এত প্রাবল্য এবং আমাদের দেশে নাই, তাহার কারণ কি আপনি কিছু বুঝাইতে পারেন?

গুরু। উত্তমরূপে পারি। ইউরোপের ধর্ম্ম, বিশেষতঃ পূর্ব্বতন ইউরোপের ধর্ম্ম, হিন্দুধর্ম্মের মত উন্নত ধর্ম্ম নহে; ইহাই সেই কারণ। একটু সবিস্তারে সেই কথাটা বুঝাইতেছি, তাহা শুন।

দেশবাৎসল্য প্রীতিবৃত্তির চরম সীমা নহে। তাহার উপর আর এক সোপান আছে। সমস্ত জগতে যে প্রীতি, তাহাই প্রীতিবৃত্তির চরম সীমা। তাহাই যথার্থ ধর্ম্ম। যত দিন প্রীতির জগৎপরিমিত স্ফূর্ত্তি না হইল, তত দিন প্রীতিও অসম্পূর্ণ-ধর্ম্মও অসম্পূর্ণ।

এখন দেখা যায় যে, ইউরোপীয়দিগের প্রীতি আপনাদের স্বদেশেই পর্য্যবসিত হয়, সমস্ত মনুষ্যলোকে ব্যাপ্ত হইতে সচরাচর পারে না। আপনার জাতিকে ভালবাসেন, অন্য জাতীয়কে দেখিতে পারেন না, ইহাই তাঁহাদের স্বভাব। অন্যান্যজাতির মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তাহারা স্বধর্ম্মীকে ভালবাসে, বিধর্ম্মীকে দেখিতে পারে না। মুসলমান ইহার উদাহরণ। কিন্তু ধর্ম্ম এক হইলে, জাতি লইয়া তাহারা বড় আর দ্বেষ করে না। মুসলমানের চক্ষে সব মুসলমান প্রায় তুল্য; কিন্তু ইংরেজখ্রীষ্টীয়ান ও রুষখ্রীষ্টীয়ানের মধ্যে বড় গোলযোগ।

শিষ্য। এ স্থলে মুসলমানেরও প্রীতি জাগতিক নহে, ইউরোপের প্রীতিও জাগতিক নহে।

গুরু। মুসলমানের প্রীতি-বিস্তারে নিরোধক তাহার ধর্ম্ম। জগৎসুদ্ধ মুসলমান হইলে জগৎসুদ্ধ সে ভালবাসিতে পারে, কিন্তু জগৎসুদ্ধ খ্রীষ্টীয়ান হইলে জর্ম্মাণ জর্ম্মাণ ভিন্ন, ফরাসি ফরাসি ভিন্ন আর কাহাকেও ভাসলবাসিতে পারে না। এখন জিজ্ঞাস্য কথা এই,-ইউরোপীয় প্রীতি দেশব্যাপক হইয়াও আর উঠিতে পারে না কেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে বুঝিতে হইবে, প্রীতিস্ফূর্ত্তির কার্য্যতঃ বিরোধী কে? কার্য্যতঃ বিরোধী আত্মপ্রীতি। পশুপক্ষীর ন্যায় মনুষ্যেতে আত্মপ্রীতিও অতিশয় প্রবলা। পরপ্রীতির অপেক্ষা আত্মপ্রীতি প্রবলা। এই জন্য উন্নত ধর্ম্মের দ্বারা চিত্ত শাসিত না হইলে, প্রীতির বিস্তার আত্মপ্রীতির দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়। অর্থাৎ পরে প্রীতি যত দূর আত্মপ্রীতির সঙ্গে সুসঙ্গত; এই পুত্র আমার, এই ভার্য্যা আমার, ইহারা আমার সুখের উপাদান, এই জন্য আমি ইহাদের ভালবাসি। তারপর কুটুম্ব, বন্ধু, স্বজন, জ্ঞাতি, গোষ্ঠীগোত্রও আমার, আশ্রিত অনুগত, ইহারাও আমার, ইহারাও আমার সুখের উপাদান, এই জন্য আমি ইহাদের ভালবাসি। তেমনি আমার গ্রাম, আমার নগর, আমার দেশ আমি ভালবাসি। কিন্তু জগৎ আমার নহে, জগৎ আমি ভালবাসিব না। পৃথিবীতে এমন লক্ষ লক্ষ লোক আছে, যাহার দেশ আমার দেশ হইতে ভিন্ন, কিন্তু এমন কেহই নাই, যাহার পৃথিবী আমার পৃথিবী হইতে ভিন্ন। সুতরাং পৃথিবী আমার নহে, আমি পৃথিবী ভালবাসিব কেন?

শিষ্য। কেন? ইহার কি কোন উত্তর নাই?

গুরু। ইউরোপে অনেক রকমের উত্তর আছে, ভারতবর্ষে এক উত্তর আছে। ইউরোপে হিতবাদীদের “Greatest good of the greatest number,” কোম্‌তের Humanity পূজা, সর্ব্বোপরি খ্রীষ্টের জাগতিক প্রীতিবাদ, মনুষ্য মনুষ্যে সকলেই এক ঈশ্বরের সন্তান, সুতরাং সকলেই ভাই ভাই, এই সকল উত্তর আছে।

শিষ্য। এই সকল উত্তর থাকিতে, বিশেষ খ্রীষ্টধর্ম্মের এই উন্নত থাকিতে, ইউরোপের প্রীতি দেশ ছাড়ায় না কেন?