শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
শঙ্কর এই শ্লোকের অর্থ এইরূপ করেন। আত্মা অচ্ছেদ্য ইত্যাদি, এজন্য আত্মা নিত্য; নিত্য-এজন্য সর্ব্বগত-এজন্য স্থিরস্বভাব; স্থিরস্বভাব-এজন্য অচল; অচল-এজন্য সনাতন, ইত্যাদি।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি || ২৫ ||
অতএব ইহাকে এইরূপ জানিয়া, শোক করিও না। ২৫।
অথ চৈন নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং49 শোচিতুমর্হসি || ২৬ ||
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং49 শোচিতুমর্হসি || ২৬ ||
আর যদি ইহা তুমি মনে কর, আত্মা সর্ব্বদাই জন্মে, সর্ব্বদা মরে, তথাপি হে মহাবাহো! ইহার জন্য শোক করিও না।২৬।
কেন তথাপি শোক করিবে না? শঙ্কর বলেন, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী বলিয়া। পরশ্লোকেও সেই কথা আছে। কিন্তু পরশ্লোকে “ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ”-এই বাক্যে আত্মার অবিনাশিতাও সূচিত হইতেছে। তাহা হইলে আর আত্মার বিনাশ স্বীকার করা হইল কৈ? এবং নূতন কথাই বা কি হইল? এই জন্য শ্রীধর আর এক প্রকার বুঝাইয়াছিলেন। তিনি বলেন যে, আত্মাও যদি মরিল, তাহা হইলে তোমাকেও ফলভোগী হইতে হইবে না, তবে আর দুঃখের বিষয় কি?
কেন তথাপি শোক করিবে না, তাহা পরশ্লোকে বলা হইতেছে।
জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ২৭ ||
তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ২৭ ||
যে জন্মে, সে অবশ্য মরে; সে অবশ্য জন্মে; অতএব যাহা অপরিহার্য্য, তাহাতে শোক করিও না।২৭।
আত্মার অবিনাশিতা গীতাকারের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করিয়াছে। “নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্” বলিয়া মানিয়া লইয়াও, উত্তরে আবার বলিতেছেন, “ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।” যদি মরিলে আবার অবশ্য জন্মিবে, তবে আত্মা অবশ্য অবিনাশী, “নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্” বলা আর খাটে না। তবে শ্রীধরের ব্যাখ্যা গ্রহণ করিলে এ আপত্তি উপস্থিত হয় না।
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব ত্র কা পরিবেদনা || ২৮ ||
অব্যক্তনিধনান্যেব ত্র কা পরিবেদনা || ২৮ ||
জীবসকল আদিতে অব্যক্ত, (কেবল) মধ্যে ব্যক্ত, (আবার) নিধনে অব্যক্ত; সেখানে শোকবিলাপ কি? ২৮।
অব্যক্ত শব্দের অর্থ পূর্ব্বে বলা হইয়াছে। শঙ্কর অর্থ করেন, “অব্যক্তমদর্শন-মনুপলব্ধির্যাং ভূতানাং” অর্থাৎ যে (যে অবস্থায়) ভূতসকলের দর্শন বা উপলব্ধি নাই। শ্রীধর অর্থ করেন; “অব্যক্তং প্রধানং তদেবাদি উৎপত্তেঃ পূর্ব্বরূপম্।” অর্থাৎ ভূত সকল উৎপত্তির পূর্ব্বে কারণরূপে অব্যক্ত থাকে। অপর সকলে কেহ শ্রীধরের, কেহ শঙ্করের অনুবর্ত্তী হইয়াছেন। শঙ্করের অর্থ গ্রহণ করিলেই অর্থ সহজে বুঝা যায়।
শ্লোকের অর্থ এই যে, যেখানে জীব সকল আদিতে অর্থাৎ জন্মের পূর্ব্বে চক্ষুরাদির অতীত ছিল; কেবল মধ্যে দিনকত জন্মগ্রহণ করিয়া ব্যক্তরূপ হইয়াছিল, শেষে মৃত্যুর পর আবার চক্ষুরাদির অতীত হইবে, তখন আর তজ্জন্য শোক করিব কেন? “প্রতিবুদ্ধস্য স্বপ্নদৃষ্টবস্তুষ্বিব শোকো ন যুজ্যতে” (শ্রীধর স্বামী)-ঘুম ভাঙ্গিলে স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুর ন্যায় জীবের জন্য শোক অনুচিত।
49 “নৈবং” পাঠান্তর