শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
এখানেও আত্মার অবিনাশিত্ববাদ জাজ্বল্যমান।
আশ্চর্য্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেন
মাশ্চর্য বদ্বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুতাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ || ২৯ ||
মাশ্চর্য বদ্বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশ্চর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি
শ্রুতাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ || ২৯ ||
এই (আত্মা)কে কেহ আশ্চর্য্যবৎ দেখেন; কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ বলেন; কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ শুনিয়া থাকেন। শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারিলেন না।২৯।
এই শ্লোকের অভিপ্রায় এই।আত্মা অবিনাশী হইলেও পন্ডিতেরাও মৃত ব্যক্তির জন্য শোক করিয়া থাকেন বটে। কিন্তু তাহার কারণ এই যে, তাঁহারাও প্রকৃত আত্মতত্ত্ব অবগত নহেন। আত্মা তাঁহাদের নিকট বিস্ময়ের বিষয় মাত্র-তাঁহারা আশ্চর্য্য বিবেচনা করেন। আত্মার দুর্জ্ঞেয়তাবশতঃ সকলের এই ভ্রান্তি।
এ কথাতে এই আপত্তি হইতে পারে যে, “আত্মা অবিনাশী” এবং “ইন্দ্রিয়াদির অবিষয়” এই সকল কথাতে এমন কিছু নাই যে, পণ্ডিতেও বুঝিতে পারে না। কিন্তু ভগবদুক্তির উদ্দেশ্য কেবল দুর্ব্বোধ্যতা প্রতিপাদন করা নহে। আমরা আত্মার অবিনাশিতা বুঝিতে পারিলেও কথাটা আমাদের হৃদয়ে বড় প্রবেশ করে না। তদ্বিষয়ক যে বিশ্বাস, তাহা আমাদের সমস্ত জীবন শাসিত করে না। এই বিশ্বাসকে আমরা একটা সর্ব্বদা জাজ্বল্যমান, জীবন্ত, সর্ব্বথা-হৃদয়ে-প্রস্ফুটিত-ব্যাপারে পরিণত করি না। ইহাই ভগবদুক্তির উদ্দেশ্য।
দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্ব্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ৩০ ||
তস্মাৎ সর্ব্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি || ৩০ ||
হে ভারত! সকলের দেহে, আত্মা নিত্য ও অবধ্য। অতএব জীব সকলের জন্য তোমার শোক করা উচিত নহে।৩০।
আত্মার অবিনাশিতা সম্বন্ধে যাহা কথিত হইল, এই শ্লোক তাহার উপসংহার।
স্বধর্ম্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে || ৩১ ||
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে || ৩১ ||
স্বধর্ম্ম প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ভীত হইও না। ধর্ম্ম্য যুদ্ধের অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয় আর নাই।৩১।
এক্ষণে ১১ ও ২২ শ্লোকের টীকায় যাহা বলা গিয়াছে, তাহা স্মরণ করিতে হইবে। স্বধর্ম্ম কি, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যুদ্ধব্যবসায়ীর স্বধর্ম্ম-যুদ্ধ। কিন্তু যোদ্ধার স্বধর্ম্ম যুদ্ধ বলিয়া যে, যুদ্ধ উপস্থিত হইলেই যে যোদ্ধাকে তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, এমন নহে। অনেক সময়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া যোদ্ধার পক্ষে অধর্ম্ম।অনেক রাজ্য পরস্বাপরহণ জন্যই যুদ্ধ করেন। তাদৃশ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া ধর্ম্মানুমত নহে। কিন্তু যুদ্ধব্যবসায়ী, মনুষ্যসমাজের দোষে তাহাকে তাহাতেও প্রবৃত্ত হইতে হয়। যোদ্ধৃগণ রাজা বা সেনাপতির আজ্ঞানুবর্ত্তী। তাঁহাদের আজ্ঞামত যুদ্ধ করিতে, অধীন যোদ্ধৃমাত্রেই বাধ্য। কিন্তু সে অবস্থায় যুদ্ধ করিলেও তাঁহারা পরস্বাপহরণ ইত্যাদি পাপের অংশী হয়েন। এই অধর্ম্মযুদ্ধই অনেক। যোদ্ধা তাহা হইতে কোনরূপে নিষ্কৃতি পান না। ভীষ্মের ন্যায় পরমধার্ম্মিক ব্যক্তিরও অন্নদাসত্ববশতঃ দুর্য্যোধনের পক্ষাবলম্বনপূর্ব্বক অধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার কথা এই মহাভারতেই আছে। ইউরোপীয় সৈন্যমধ্যে খুঁজিলে ভীষ্মের অবস্থাপন্ন লোক সহস্র সহস্র পাওয়া যাইবে। অতএব যোদ্ধার এই মহৎ দুর্ভাগ্য যে, স্বধর্ম্ম পালন করিতে গিয়া, অনেক সময়েই অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হয়। ধার্ম্মিক যোদ্ধা ইহাকে মহদ্দুঃখ বিবেচনা করেন। কিন্তু ধর্ম্মযুদ্ধও আছে। আত্মরক্ষা, স্বজনরক্ষা, সমাজরক্ষা, দেশরক্ষা, সমস্ত প্রজার রক্ষা, ধর্ম্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ উপস্থিত হয়। এইরূপ যুদ্ধে যোদ্ধার অধর্ম্ম সঞ্চয় না হইয়া পরম ধর্ম্ম সঞ্চয় হয়। এখানে কেবল স্বধর্ম্মপালন নহে, তাহার সঙ্গে অনন্ত পুণ্য সঞ্চয়। এরূপ ধর্ম্মযুদ্ধ যে যোদ্ধার অদৃষ্টে ঘটে, সে পরম ভাগ্যবান্। অর্জ্জুনের সেই সময় উপস্থিত, এরূপ যুদ্ধে অপ্রবৃত্তি পরম অধর্ম্ম-অনর্থক স্বধর্ম্মপরিত্যাগ। অর্জ্জুন সেই অনর্থক স্বধর্ম্মপরিত্যাগরূপ ঘোরতর অধর্ম্মে প্রবৃত্ত। ইহার কারণ আর কিছু নহে। কেবল স্বজনাদি নিধনের ভয়। সেই ভয়ে ভীত শোকাকুল বা মুগ্ধ হইবার কোন কারণ নাই, তাহা ভগবান্ বুঝাইলেন; বুঝাইলেন যে, কেহ মরিবে না-কেন না, দেহী অমর। যাইবে কেবল শূন্য দেহ। কিন্তু সেটা ত জীর্ণ বস্ত্র মাত্র। অতএব স্বজনবধাশঙ্কায় ভীত হইয়া স্বধর্ম্মে উপেক্ষা করা অকর্ত্তব্য। এই ধর্ম্মযুদ্ধের মত এমন মঙ্গলময় ব্যাপার ক্ষত্রিয়ের আর ঘটে না। ইহাই শ্লোকার্থ।