মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত
তারপর মুচিরাম কলিকাতার ইংরেজ মহল আক্রমণ করিলেন। রামবাবুর পরিচয়ে যত ছোট বড় ইংরেজের বাড়ী যাতায়াত করিলেন। অনেক জায়গাতেই ঝাঁটা লাথি খাইলেন। কোন কোন স্থানে মিষ্ট কথা পাইলেন। অনেক স্থানেই একজন মাতালো জমীদার বলিয়া পরিচিত হইলেন।
তারপর ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আসোসিয়েশ্যনে ঢুকিলেন। নাম লেখাইয়া বৎসর বৎসর টাকা দিতে লাগিলেন। রামচন্দ্রবাবুর সঙ্গে প্রতি অধিবেশনে যাইতে আরম্ভ করিলেন। রামবাবু কথিত মহামহিমমহাসভার “একটা বড় কামান |” তিনি যখনই বড় কামান দাগিতে যাইতেন, এই ছোট মুচিপিস্তলটি সঙ্গে লইয়া যাইতেন-সুতরাং পিস্তলটি ক্রমে মুখ খুলিয়া পুটপাট করিতে আরম্ভ করিল। মুচিরামও ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সভায় একজন বক্তা হইয়া দাঁড়াইলেন। তিনি বকিতেন মাথামুণ্ডু, কিন্তু ছাপার বিজ্ঞাপনীতে যাহা বাহির হইত, সে আর একপ্রকার। মুচিরাম নিজে তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেন না। যাহারা বুঝে, তাহারা পড়িয়া নিন্দা করিত না। সুতরাং মুচিরাম ক্রমে একজন প্রসিদ্ধ বক্তা বলিয়া খ্যাতি লাভ করিতে লাগিলেন। যেখানে লোকে বড়লোক বলিয়া গণ্য হয়, মুচিরাম তাহার কোন যায়গায় যাইতেই ছাড়িত না। গবর্ণমেণ্ট হৌসে ও বেলবিডীরে গেলে বড়লোক বলিয়া গণ্য হয়, সুতরাং সে গবর্ণমেণ্ট হৌসে ও বেলবিডীরে যাইত। যাইতে যাইতে সে লেপ্টেনান্ট গবর্ণরের নিকট সুপরিচিত হইল। লেপ্টেনাণ্ট গবর্ণর তাহাকে একজন নম্র, নিরহঙ্কারী, নিরীহ লোক বলিয়া জানিলেন। জমীদারী সভার একজন নায়ক বলিয়া পূর্ব্বেই রামচন্দ্রের নিকট পরিচয় পাইয়াছিলেন।
সম্প্রতি বাঙ্গাল কৌন্সিলে একটি পদ খালি হইল। একজন জমীদারী সভার অধিনায়ককে তাহাতে প্রতিষ্ঠিত করিবেন, ইহাই লেপ্টেনাণ্ট গবর্ণর স্থির করিলেন। বাছনি করিতে মনে মনে ভাবিলেন, “মুচিরামের ন্যায় এ পদের যোগ্য কে? নিরহঙ্কারী, নিরীহ-সেকেলে খাঁটি সোণা, একালের ঠন্ঠনে পিতল নয়। অতএব মুচিরামকে বহাল করিব |”
অচিরাৎ অনরেবল বাবু মুচিরাম রায় বাঙ্গাল কৌন্সিলে আসন গ্রহণ করিলেন।
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
বড় বাড়াবাড়িতে অনরেবল মুচিরাম রায়ের রুধির শুকাইয়া আসিল। ভজগোবিন্দ ফিকিরফন্দিতে অল্প দামে অধিক লাভের বিষয়গুলি কিনিয়া দিয়াছিলেন-তাঁহার কার্য্যদক্ষতায় ক্রীত সম্পত্তির আয় বাড়িয়াছিল-কিন্তু এখন তাহাতেও অনাটন হইয়া আসিল। দুই একখানি তালুক বাঁধা পড়িল-রামচন্দ্রবাবুর কাছে। রামচন্দ্রবাবুর সঙ্কল্প এতদিনে সিদ্ধ হইয়া আসিতেছিল-এই জন্য তিনি আত্মীয়তা করিয়া মুচিরামকে এত বড় বাবু করিয়া তুলিয়াছিলেন। রামচন্দ্র অর্দ্ধেক মূল্যে তালুকগুলি বাঁধা রাখিলেন-জানেন যে, মুচিরাম কখনও শুধরাইতে পারিবে না- অর্দ্ধেক মূল্যে বিষয়গুলি তাঁহার হইবে। আরও তালুক বাঁধা পড়ে, এমন গতিক হইয়া আসিল। এই সময়ে ভজগোবিন্দ আসিয়া উপস্থিত হইল। সে শুনিয়াছিল যে, গবর্ণর প্রভৃতি বড় বড় সাহেব তাহার ভগিনীপতির হাতধরা-এই সুযোগে একটা বড় চাকরি যোটাইয়া লইতে হইবে-এই ভরসায় ছুটি লইয়া কলিকাতায় আসিলেন। আসিয়া শুনিলেন, মুচিরামের গতিক ভাল নহে। তাহার উদ্ধারের উপায় বলিয়া দিলেন।
বলিলেন, “মহাশয়, আপনি কখন তালুকে যান নাই। গেলেই কিছু পাওয়া যাইবে। তালুকে যান |”
মুচিরাম আনন্দিত হইল, ভাবিল, “তাই ত! এমন সোজা কথাটা আমার মনে আসিল না |” মুচিরাম খুশী হইয়া, ভজগোবিন্দের কথায় স্বীকৃত হইল।
চন্দনপুর নামে তালুক-সেইখানে বাবু গেলেন। প্রজাদিগের অবস্থা বড় ভাল। সে বৎসর নিকটবর্ত্তী স্থান সকলে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত-কিন্তু সে মহালে কিছু না। কখন মুচিরাম প্রজাদিগের নিকট মাঙ্গন মাথট লয়েন নাই। মুচিরাম নির্ব্বিরোধী লোক-তাহাদের উপর কোন অত্যাচার করিতেন না। আজ ভজগোবিন্দের পরামর্শে সশরীরে তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “আমার কন্যার বিবাহ উপস্থিত-বড় দায়গ্রস্ত হইয়াছি, কিছু ভিক্ষা দাও |” প্রজারা দয়া করিল-প্রজা সুখে থাকিলে জমীদারকে সকল সময়ে দয়া করিতে প্রস্তুত। জমীদার আসিয়াছে সম্বাদ পাইয়া, পালে পালে প্রজা টেঁকে টাকা লইয়া মুচিরাম-দর্শনে আসিতে আরম্ভ করিল। মুচিরামের চেষ্ট টাকায় পরিপূর্ণ হইতে লাগিল, কিন্তু ইহাতে আর একদিকে তাঁহার আর একপ্রকার সৌভাগ্যের উদয় হইল।