প্রজারা দলে দলে মুচিরাম দর্শনে আসে-কোন দিন পঞ্চাশ, কোন দিন ষাট, কোন দিন আশী, কোন দিন একশত এইরূপ। যাহাদের বাড়ী নিকট, তাহারা দর্শন করিয়া ফিরিয়া যায়, যাহাদের বাড়ী দূর, তাহারা দোকান হইতে খাদ্যসামগ্রী কিনিয়া একটা বাগানের ভিতর রাঁধিয়া বাড়িয়া খায়। মহালটি একে খুব বড়-মুচিরামের এত বড় জমীদারী আর নাই-তাহাতে গ্রামগুলির মধ্যে বিল খাল অনেক থাকায়, দুই চারিজন প্রজাকে প্রায় রাঁধিয়া খাইয়া যাইতে হইত। একদিন অনেক দূর হইতে প্রায় একশত প্রজা আসিয়াছে–তাহাদের বাড়ী একটা ভারি জলা পার; নিকাশ প্রকাশে তাহাদের বেলা গেল; তাহারা বাড়ী ফিরিতে পারিল না। বাগানে রাঁধাবাড়া করিতে লাগিল। রাত্রি থাকিয়া প্রাতে যাত্রা করিবে। তাহারা যখন খাইতে বসিল, সেই সময়ে নিকটস্থ মাঠ পার হইয়া অশ্বযানে, একটি সাহেব যাইতেছিলেন।

সাহেবটির নাম মীন্‌ওয়েল্। তিনি ঐ জেলার প্রধান রাজপুরুষ-ম্যাজিষ্ট্রেট কালেক্টর। সাহেবটি ভাল লোক-ন্যায়বান্-হিতৈষী এবং পরিশ্রমী। কিসে এ দেশের লোকের মঙ্গল সাধন করিবেন, সেই জন্য সর্ব্বদা চিন্তিত। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সে বৎসর ঐ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল; সাহেব দুর্ভিক্ষের তদারকে বাহির হইয়াছিলেন। নিকটস্থ কোন গ্রামে তাঁহার তাম্বু পড়িয়াছিল-তিনি এখন অশ্বারোহণে তাম্বুতে যাইতেছিলেন। যাইতে যাইতে দেখিতে পাইলেন, একটা বাগানের ভিতর কতকগুলা লোক ভোজন করিতেছে।

দেখিয়াই সহজেই সিদ্ধান্ত করিলেন, ইহারা সকলে দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসী দরিদ্র লোক, কোন বদান্য ব্যক্তি ইহাদের ভোজন করাইতেছে। সবিশেষে তত্ত্ব জানিবার জন্য, নিকটে একজন চাষাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন।

চাষা অবশ্য ইংরেজি জানে না। সাহেব উত্তম বাঙ্গালা জানেন, পরীক্ষা দিয়া পুরস্কার পাইয়াছেন; সুতরাং চাষার সঙ্গে বাঙ্গালায় কথোপকথন আরম্ভ করিলেন।

সাহেব চাষাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাডিগের গ্‌ড়ামে1 ডুড়্‌বেক্কা2 কেমন আছে?” চাষা তো জানে না ডুড়্‌বেক্কা কাহাকে বলে। সে ফাঁফরে পড়িল। ডুড়্‌বেক্কা কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম হইবে, ইহা একপ্রকার স্থির হইল। কিন্তু “কেমন আছে?” ইহার উত্তর কি দিবে? যদি বলে যে, সে ব্যক্তিকে আমি চিনি না, তাহা হইলে সাহেব হয়ত এক ঘা চাবুক দিবে, যদি বলে যে, ভাল আছে, তাহা হইলে সাহেব হয়ত ডুড়্‌বেক্কাকে ডাকিয়া আনিতে বলিবে; তাহা হইলে কি করিবে? চাষা ভাবিয়া চিন্তিয়া উত্তর করিল, “বেমার আছে |”

“বেমার-Sick?” সাহেব ভাবিতে লাগিলেন, “Well, there may be much sickness without there being any scarcity-the fellow does not understand perhaps; these people are so dull-I say ডুড়্‌বেক্কা কেমন আছে-অঢিক আছে কিংবা অল্প আছে?”

এখন চাষা কিছু ভাব পাইল। স্থির করিল যে, এ যখন সাহেব, তবে অবশ্য হাকিম। (সে দেশের নীলকর নাই) হাকিম যখন জিজ্ঞাসা করিতেছে যে, ডুড়্‌বেক্কা অধিক আছে, কি অল্প আছে-তখন ডুড়্‌বেক্কা একটা টেক্সের নাম না হইয়া যায় না। ভাবিল, কই, আমরা ত ডুড়্‌বেক্কার টেক্স দিই না; কিন্তু যদি বলি, আমাদের গ্রামে সে টেক্স নাই-তবে বেটা এখনই টেক্স বসাইয়া যাইবে। অতএব মিছা কথা বলাই ভাল। সাহেব পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “টোমাডের গ্‌ড়ামে ডুড়্‌বেক্কা অঢিক কিম্বা অল্প আছে?”

চাষা উত্তর করিল, “হুঁজুর, আমাদের গাঁয়ে ভারি ডুড়্‌বেক্কা আছে |”

সাহেব ভাবিলেন, “Hump! I thought as much___” পরে বাগানে যে সকল লোক খাইতেছিল, তৎপ্রতি অঙ্গুলিনির্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে বোজন করিল?” (উদ্দেশ্য “ভোজন করাইল”)

চাষা। প্রজারা ভোজন কোচ্ছে।

1 গ্রামে।

2 দুর্ভিক্ষ।