যে গলিতে মুচিরাম বাড়ী লইয়াছিলেন, সেই গলিতে একজন প্রথমশ্রেণীর বাটপাড় বাস করিতেন। তাঁহার নাম রামচন্দ্র দত্ত। রামচন্দ্রবাবু প্রথমশ্রেণীর বাটপাড়-একটু ব্রান্ডি বা একখানা কাটলেটের লোভে কাহারও আনুগত্য করিবার লোক নহেন। তাঁহার ত্রিতল গৃহ, প্রস্তরমুকুর কাষ্ঠ কাচ কার্পেটাদিতে সকুসুম উদ্যানতুল্য রঞ্জিত; তাঁহার দরওয়াজায় অনেকগুলো দ্বারবান্ গালচাল্লা বাঁধিয়া সিদ্ধি ঘোঁটে; আস্তাবলে অনেকগুলি অশ্বের পদধ্বনি শুনা যায়-তিনখানা গাড়ি আছে, সোণাবাঁধা হুঁকা, হীরাবাঁধা গৃহিণী, হ্যাণ্ডনোটে বাঁধা ইংরেজ খাদক, এবং তাড়াবাঁধা ‘কাগজ’-সকলই ছিল। তথাপি তিনি জুয়াচোর-জুয়াচুরিতেই এ সকল হইয়াছিল। তিনি যখন শুনিলেন, টাকার বোঝা লইয়া গ্রাম্য গর্দ্দভ পাড়ায় আসিয়া চরিয়া বেড়াইতেছে, তখন ভাবিলেন যে, গর্দ্দভের পৃষ্ঠ হইতে টাকার বোঝাটি নামাইয়া লইয়া তাহার উপকার করিতে হইবে। আহা! অবোধ পশু! এত ভারি বোঝা বহিবে কি প্রকারে-বোঝাটি নামাইয়া লইয়া তাহার উপকার করি।

প্রথম প্রয়োজন, মুচিরামের সঙ্গে আলাপ পরিচয়। রামচন্দ্রবাবু বড়লোক-মুচিরামের বাড়ী আগে যাইবেন না। ইঙ্গিত পাইয়া একজন অনুচর মুচিরামের কাণে তুলিয়া দিল, রামচন্দ্রবাবু কলিকাতার অতি প্রধান লোক, আর মুচিরামের প্রতিবাসী-মুচিরামের সঙ্গে আলাপ করিবার জন্য অতি ব্যস্ত। সুতরাং মুচিরাম গিয়া উপস্থিত।

এইরূপে উভয়ে উভয়ের নিকট পরিচিত হইলেন। উভয়ে উভয়ের বাড়ী যাতায়াত হইতে লাগিল। ঘন ঘন যাতায়াতে ক্রমে সৌহার্দ্দ্য বৃদ্ধি। রামচন্দ্রবাবুর সেই ইচ্ছা! তিনি চতুর, মুচিরাম নির্ব্বোধ; মুচিরাম গ্রাম্য, তিনি নাগরিক। অল্প কালেই মুচিরাম-মৎস্য ফাঁদে পড়িল-রামচন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুতা করিল। রামচন্দ্র তাঁহার মুরুব্বি হইলেন-মুচিরামের নাগরিক জীবনযাত্রানির্ব্বাহে শিক্ষাগুরু হইলেন।


ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
তিনি নাগরিক জীবননির্ব্বাহে মুচিরামের শিক্ষাগুরু-কলিকাতারূপ গোচারণভূমে তাঁহার রাখাল-কালীঘাট হইতে চিতপুর পর্য্যন্ত, তখন মুচিরামবলদ সখের গাড়ি টানিয়া যায়, রামবাবু তখন তাহার গাড়োয়ান; সখের ছেকড়ায় এই খোঁড়া টাটুটি জুড়িয়া, রামচন্দ্র পাকা কোচমানের মত মিঠাকড়া চাবুক লাগাইতেন। তাঁহার হস্তে ক্রমে গ্রাম্য বানর সহুরে বানরে পরিণত হইল। কি গতিকের বানর, তাহা নিম্নোদ্ধৃত পত্রাংশ পড়িলেই বুঝা যাইতে পারে। এই সময় তিনি ভজগোবিন্দকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা হইতে উদ্ধৃত করা গেল-

“তোমার পুত্রের বিবাহ শুনিয়া আহ্লাদ হইল। টাকায় তেমন আনুকূল্য করিতে পারিলাম না-মাপ করিও। দুইখানা গাড়ি কিনিয়াছি-একখানা বেরুষ-একখানা ব্রৌনবেরি। একটা আরবের যুড়িতে ২২০০ টাকা পড়িয়াছে। ছবিতে, আয়নাতে, কারপেটে অনেক টাকা পড়িয়া গিয়াছে। কলিকাতার এত খরচ, তাহা জানিলে কখন আসিতাম না-সেখানে সাত সিকায় কাপড় ও মজুরিসমেত আমার একটা চাপকান তৈয়ার হইত-এখানে একটা চাপকানে ৮৫ টাকা পড়িয়াছে। এক সেট রূপার বাসনে অনেক টাকা লাগিয়াছে। থাল, বাটি, গেলাস, সে বাসনের কথা বলিতেছি না-এ সেট টেবিলের জন্য। বরকন্যাকে আমার হইয়া আশীর্ব্বাদ করিবে।”

এই হলো বানরামি নম্বর এক। তারপর, মুচিরাম কলিকাতায় যে কেহ একটু খ্যাতিযুক্ত, তাহারই বাড়ীতে, রামচন্দ্রবাবুর পশ্চাতে পশ্চাতে যাইতে আরম্ভ করিলেন। কোন নামজাদা বাবু তাঁহার বাড়ীতে আসিলে জন্ম সার্থক মনে করিতেন। কিসে আসে, সেই চেষ্টায় ফিরিতেন। এইরূপ আচরণে, রামবাবুর সাহায্যে, কলিকাতার সকল বর্দ্ধিষ্ণু লোকের সঙ্গে তাঁহার আলাপ হইল। টাকার মান সর্ব্বত্র; মুচিরামের টাকা আছে; সুতরাং সকলেরই কাছে তাঁহার মান হইল।