কমলাকান্ত-পরিশিষ্ট
এই বলিয়া প্রসন্ন খাঁচাটা তুলিয়া লইয়া ঠিকুরে বেরিয়ে গেল। কেঁড়ের দুধ চল্কে কাপড় বাহিয়া পড়িতে লাগিল। O what a fall was there!
আমি ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া পাখীর সন্ধানে বাহির হইলাম। অনেক ঘুরিলাম, অনেক পাখীর দোকানে গেলাম। কোথাও মনের মতন পাখী পাইলাম না। শেষে এক দোকানে একটি পাখী মনোনীত হইল, কিন্তু তখনই দামের কথা মনে পড়িল। আমি শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী, আমার ত একটি পয়সাও নাই; তবে কি বলিয়া পাখী কিনিতে আসিলাম? কিছু অবসন্ন হইলাম; কিন্তু তখনই মনে হইল যে কমলাকান্তের দেশে কয়জন সম্বলবিশিষ্ট লোক আছে? আর সম্বলহীন হইয়াও কে না বড় বড় সওদার চেষ্টায় ফিরিতেছে? কে না বড় বড় পদ, লম্বা লম্বা, খেতাবের জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? কিন্তু তাহারা কেহই ত লজ্জা, অপমান, ঘৃণা, কিছুই অনুভব করে না! তবে আমিই কেন লজ্জিত হই? এইরপ ভাবিতে ভাবিতে আসিতেছি, এমন সময় কর্কশ শব্দ শুনিতে পাইলাম। শব্দটা এইরূপ- Plateetud, Plateetud, Plateetud, বারম্বার এই অশ্রুতপূর্ব্ব শব্দ শুনিয়া শব্দের কারণ জানিবার ইচ্ছা হইল। খুঁজিতে খুঁজিতে এক দরিদ্র মুসলমানের বাড়ীতে আসিলাম। উঁকি মারিয়া দেখিলাম উঠানে এক কচ্ছহীন বীরপুরুষ কতকগুলো মুর্গী জবাই করিতেছে –রক্তের স্রোত বহিয়া যাইতেছে। একখানা ঘরের দাবায় একটা স্ত্রীলোক পড়িয়া ছট্ফট্ করিতেছে, এবং বিষম যন্ত্রণাসূচক চীৎকার করিতেছে। ঘরের চালে ডাঁড়ে বসিয়া একটা পাখী একবার সেই রক্তের স্রোত দেখিতেছে, একবার সেই স্ত্রীলোকটাকে দেখিতেছে এবং আহ্লাদে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছে। এক একবার স্ত্রীলোকটাকে ঠোক্রাইবার চেষ্টা করিতেছে, এবং ঘুরিয়া ফিরিয়া Plateetud, Plateetud করিতেছে। আমি গৃহস্বামীকে ডাকিলাম। গৃহস্বামী বাহিরে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম –তোমার বাড়ীতে কাহার কোন পীড়া হইয়াছে?
গৃ-স্বা। হাঁ, আমার স্ত্রীর হাঁটুতে বড় একটা বেদনা হইয়াছে। আমি সেইজন্য বড় বিপাকে পড়িয়াছি। আমার বাড়ীতে আজ দশজন লোক খাবে, আর এই বিপদ্।
আ। আমি একটা ঔষধ দিতেছি; জলে গুলিয়া হাঁটুতে মালিশ করিয়া দাও, শীঘ্র আরাম হইবে। কিন্তু আমাকে কি দিবে?
গৃ-স্বা। আপনি কি চান?
আ। ঐ পাখীটা।
গৃ-স্বা। এখনি লইয়া যান। ওটাকে আমি খুব যত্ন করিয়া আনিয়াছিলাম, কিন্তু মহাশয়, এখন ওটা আমার ছেলেপিলেকে ঠুক্রে ঠুক্রে মারিয়া ফেলিতেছে। আপনি এখনই লইয়া যান।
তখন আমি বিষম গোলে পড়িলাম। আফিঙ্গ দিই কেমন করিয়া? যা আফিঙ্গ দেবাসুরে সমুদ্র মন্থন করিয়া, সৃষ্টির সারভূত পদার্থস্বরূপ লাভ করিয়া আমি লোভ-পরিশূন্যসংসার-বিরাগী বলিয়া আমার জিম্মায় রাখিয়াছেন, সে আফিঙ্গ দিই কেমন করিয়া? কিন্তু না দিলেও নয়। প্রসন্নের কাছে মুখ রাখা চাই, সেই দুধ দেয়। দেবাসুরে আমাকে এক ছিলিম তামাকুও দেয় না। সুতরাং ক্ষণেক ইতস্ততঃ করিয়া অবশেষে চক্ষু বুজিয়া ছোট্ট একটি গুলি গৃহস্বামীর হাতে দিয়া পাখীটা লইয়া চলিয়া আসিলাম। কাজটা মন্দ করিলাম কি? উপকার করিয়া তাহার মূল্যস্বরূপ পাখীটা লইলাম। কে না লয়? ডাক্তার মহাশয়েরা দরিদ্র রোগীর নিকট হইতে কি Fee লয়েন না উকীল মহাশয়েরা নিঃস্ব মোয়াক্কেলের নিকট হইতে ফি লয়েন না? রাজপুরুষেরা দরিদ্র গৃহস্থের নিকট হইতে টেক্স লয়েন না? কুলকামিনীরা দরিদ্র স্বামীর নিকট হইতে খোরপোষ লয়েন না? তবে আমিই কি এমন ভয়ানক কাজ করিলাম?
সেই দিন সন্ধ্যার পর আফিঙ্গ খাইয়া পাখীর ডাঁড়টা সামনে ঝুলাইয়া তামাকু খাইতে বসিলাম। ক্রমে আফিঙ্গ চড়িয়া উঠিল। তখন শুনিলাম পাখীটা বলিতেছে –আমাকে কেন তেমন জায়গা হইতে এখানে আনিলে? Plateetud, Plateetud।
আ। তুমি এই যে বেশ কথা কহিতে পার! তোমার নাম কি, বাড়ী কোথা?
পা। আমার নাম কাকাতুয়া, অর্থাৎ, তুয়া কাকা। তোমাদিগকে uncleship শিখাইবার নিমিত্ত আমার এ প্রদেশে আগমন। Plateetud, Plateetud।
আ। তুমি তবে এ দেশীয় নও? তোমার বাড়ী কোথা?
পা। আপাততঃ এখান হইতে অনেক পশ্চিমে।
আ। আগে কোথায় থাক্তে?
পা। সে অনেক কথা। শুনিবে কি?
আ। শুনিব। আজ কাল অনেকে পুরাতত্ত্ব চর্চ্চা করিয়া খুব সস্তাদরে নাম কিন্চে, দেখি যদি আমিও কিছু করিতে পারি।