কাকাতুয়া
শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী প্রণীত
মাস পাঁচ ছয় হইল, একদিন প্রাতে স্নানাদিক্রিয়াসম্পন্ন করিয়া কিঞ্চিৎ গুড় ছোলা খাইয়া বসিয়া তামাকু টানিতেছি, এমন সময় প্রসন্ন গোয়ালিনী আসিয়া উপস্থিত। সু-বামহস্ত কোমরস্থিত সাধুভাণ্ড জড়াইয়া রহিয়াছে, পোড়া ডান হাতে একটা পাখীর খাঁচা। খাঁচাটা অতি সাবধানে মাটিতে রাখিয়া প্রসন্ন বসিল। রকম দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কত রঙ্গই জান?

প্রসন্ন উত্তর করিল-কেন, রঙ্গ আবার কি দেখিলে?

আ। তোমার সব দুধ দই আমাকে না দিয়া পাঁচজনকে বেচিয়া বেড়াও, এই ত এক রঙ্গ। আবার এতদিনের পর নূতন পাখী কেন?

প্র। নূতন পুরাতন আবার কি? আমি ত আর কখন পাখী পুষি নাই।

আ। সে কি প্রসন্ন? আর কখন পাখী পোষ নাই কি? আমিই যে তোমার খাঁচার পাখী-তোমার ঐ পরম ভাণ্ডের মধ্যে আমি শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী ক্ষীরোদশয্যাশায়ী অনন্ত পুরুষের ন্যায় সদাই যোগমুগ্ধ। ঐ ক্ষীরাধার ভাণ্ড আমার অনন্তশয্যারূপী খাঁচা। আমি ঐ খাঁচার ক্ষীরপায়ী পক্ষী। তাই বলি, আবার একটা পাখী কেন?

প্র। দেখিলাম পাখীটা আর একটা পাখীর বাসায় ঢুকিতে গিয়া ঠোকর খাইয়া মাটিতে পড়িয়া ধড়ফড় করিতেছে। দেখিয়া বড় দুঃখ হইল; তাই পাখীটাকে খাঁচায় পুরিয়া আনিলাম।

আ। যে পরের বস্তু লইবার জন্য অনধিকার-প্রবেশের চেষ্টা করে, তাহার জন্য আবার দুঃখ কি? সে ত ঘোর অত্যাচারী! পিনালকোডের ৫১১ ধারানুসারে সে ষোল আনা চুরি এবং অনধিকার-প্রবেশের দায়ে দায়ী, তা জানিস্!

প্র। অমন কথা বল না! ওর কিছু নাই বলিয়াই অমন অসাহসের কাজ করিতে গিয়াছিল। আহা! যার নাই, তাকে যদি লোকে না দেবে ত সে কোথায় যাবে-আমরা মেয়েমানুষ এই ত বুঝি।

প্রসন্নের মুখে দান দাতব্যের কথা বড়ই ভয়াবহ। আমার এককালে ভয় এবং রাগের সঞ্চার হইল। গরম হইয়া বলিলাম-

তবে বুঝি ওই পাখীটাকে তোর যথাসর্ব্বস্ব দিবি? আমি বুঝি আমার এই দুগ্ধপুষ্ট তনুখানি গঙ্গাজলে ভাসাইয়া দিব?

প্র। ও কি রকম কথা? আমি কি তোমাকে তাই করতে বলছি?

আ। নয়ই বা কেন? ঐ পাখীটাই যদি তোর সব দুধ দই খেলে, তবে আমি বাতাস খেয়ে থাকব না Huxley সাহেবের protoplasm খেয়ে থাকব?

প্র। কেন, তুমিও খাবে, ও-ও খাবে।

আ। না, প্রসন্ন, কমলাকান্ত সরিকিতে নাই।

প্র। সে আবার কি?

আ। ভাগাভাগিতে আমি নাই। দায়ভাগের ভাগাভাগির ভয়ে আমি সংসারধর্ম্মেই করিলাম না। আবার তোর ভাঁড়েও ভাগাভাগি?

প্র। কেন, তুমিই ত সে দিন কত দান ধর্ম্মের কথা, কত হোমান্‌টি মটরসুঁটির কথা বলছিলে?

আ। সে পরকে শেখাবার জন্য।

প্র। ও মা, সে কি গো! আপনার বেলা লীলাখেলা পাপপুণ্য পরের বেলা!

আ। প্রসন্ন, কমলাকান্তের জাতিকে তুই এখনও চিনিস্ নাই। তা সে সব কথা যাক্। পাখীটাকে ছেড়ে দে।

প্র। তা হবে না। যাকে একবার ঠাঁই দিয়েছি তাকে তাড়াতে পার্‌ব না।

আ। সেটা ত তোদের জাতিরই ধর্ম্ম নয়?

এবার প্রসন্ন রাগিল। বলিল-

কি, বামণ, তুমি ধর্ম্ম ধর্ম্ম কর? তোমার মতন দুর্ম্মুখ ত ভূ-ভারতে নাই। তোমার কাছে আবার মানুষ আসে?

এই বলিয়া প্রসন্ন উঠিল। প্রত্যহ প্রাতে আমাকে যে দুধটুকু দেয় তাহা না দিয়াই চলিল। দুধ চলিয়া যায় দেখিয়া আমি রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলাম –আচ্ছা, আমিও একটা পাখী পুষিব, আমার যা কিছু আছে সব তাকে দিব। প্রসন্ন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া খাঁচাটা মাটীতে রাখিয়া দক্ষিণ হস্ত নাড়িয়া আমাকে বলিল –আচ্ছা, আমিও এই বলে যাচ্চি, যে দিন তুমি পাখীকে পোষমানাতে পার্‌বে, সেই দিন আমি আমার এই দুধের কেঁড়ে ভেঙ্গে ফেল্‌ব।