দেবী চৌধুরাণী
ভ। লোকটা কে?
দেবীর মুখে নামটা একটু বাধ বাধ করিল–কিন্তু নাম না করিলেও নয়–ভবানীর সঙ্গে প্রতারণা চলিবে না। অতএব অগত্যা দেবী বলিল, “তার নাম ব্রজেশ্বর রায়।”
ভ। আমি তাকে বিলক্ষণ চিনি। তাকে তোমার কি প্রয়োজন?
দেবী। কিছু দিবার প্রয়োজন ছিল। তার বাপ ইজারাদারের হাতে কয়েদ যায়। কিছু দিয়া ব্রাহ্মণের জাতিরক্ষা করিয়াছি।
ভ। ভাল কর নাই। হরবল্লভ রায় অতি পাষণ্ড। খামকা আপনার বেহাইনের জাতি মারিয়াছিল–তার জাতি যাওয়াই ভাল ছিল।
দেবী শিহরিল। বলিল, “সে কি রকম?”
ভ। তার একটা পুত্রবধূর কেহ ছিল না, কেবল বিধবা মা ছিল। হরবল্লভ সেই গরিবের বাগদী অপবাদ দিয়া বউটাকে বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দিল। দুঃখে বউটার মা মরিয়া গেল।
দেবী। আর বউটা?
ভ। শুনিয়াছি, খাইতে না পাইয়া মরিয়া গিয়াছে।
দেবী। আমাদের সে সব কথায় কাজ কি? আমরা পরহিত-ব্রত নিয়েছি, যার দুঃখ দেখিব, তারই দুঃখ মোচন করিব।
ভ। ক্ষতি নাই। কিন্তু সম্প্রতি অনেকগুলি লোক দারিদ্র্যগ্রস্ত–ইজারাদারের দৌরাত্ম্যে সর্বস্ব গিয়াছে। এখন কিছু কিছু পাইলেই, তাহারা আহার করিয়া গায়ে বল পায়। গায়ে বল পাইলেই তাহারা লাঠিবাজি করিয়া আপন স্বত্ব উদ্ধার করিতে পারে। শীঘ্র একদিন দরবার করিয়া তাহাদিগের রক্ষা কর।
দেবী। তবে প্রচার করুন যে, এইখানেই আগামী সোমবার দরবার হইবে।
ভ। না। এখানে আর তোমার থাকা হইবে না। ইংরেজ সন্ধান পাইয়াছে, তুমি এখন এই প্রদেশে আছ। এবার পাঁচ শত সিপাহী লইয়া তোমার সন্ধানে আসিতেছে। অতএব এখানে দরবার হইবে না। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দরবার হইবে, প্রচার করিয়াছি। সোমবার দিন অবধারিত করিয়াছি। সে জঙ্গলে সিপাহী যাইতে সাহস করিবে না–করিলে মারা পড়িবে। ইচ্ছামত টাকা সঙ্গে লইয়া আজি বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে যাত্রা কর।
দেবী। এবার চলিলাম। কিন্তু আর আমি এ কাজ করিব কি না সন্দেহ। ইহাতে আমার মন নাই।
এই বলিয়া দেবী উঠিল। আবার জঙ্গল ভাঙ্গিয়া বজরায় গিয়া উঠিল। বজরায় উঠিয়া রঙ্গরাজকে ডাকিয়া চুপি চুপে এই উপদেশ দিল, “আগামী সোমবার বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দরবার হইবে। এই দণ্ডে বজরা খোল–সেইখানেই চল–বরক ন্দাজদিগের সংবাদ দাও, দেবীগড় হইয়া যাও–টাকা লইয়া যাইতে হইবে। সঙ্গে অধিক টাকা নাই।”
তখন মুহূর্ত মধ্যে বজরার মাস্তুলের উপর তিন চারিখানা ছোট বড় সাদা পাল বাতাসে ফুলিতে লাগিল; ছিপখানা বজরার সামনে আসিয়া বজরার সঙ্গে বাঁধা হইল। তাহাতে ষাট জন জোয়ান বোটে লইয়া বসিয়া, ‘রাণীজি-কি জয়’ বলিয়া বাহিতে আরম্ভ করিল–সেই জাহাজের মত বজরা তখন তীরবেগে ছুটিল। এদিকে দেখা গেল, বহুসংখ্যক পথিক বা হাটুরিয়া লোকের মত লোক, নদীতীরে জঙ্গলের ভিতর দিয়া বজরার সঙ্গে দৌড়াইয়া যাইতেছে। তাহাদের হাতে কেবল এক এক লাঠি মাত্র–কিন্তু বজরার ভিতর বিস্তর ঢাল, সড়কি, বন্দুক আছে। ইহারা দেবীর “বরক্ন্দাজ” সৈন্য।
সব ঠিক দেখিয়া, দেবী স্বহস্তে আপনার শাকান্ন পাকের জন্য হাঁড়িশালায় গেল। হায়! দেবী!–তোমার এ কিরূপ সন্ন্যাস!