দেবী চৌধুরাণী
ভ। রাগ কর কেন? আমরা যে অভিপ্রায়ে ডাকাইতি করি, তা মন্দ কাজ বলিয়া আমরা জানি না। তাহা হইলে, এক দিনের তরেও ঐ কাজ করিতাম না। তুমিও এ কাজ মন্দ মনে কর না, বোধ হয়–কেন না, তাহা হইলে এ দশ বৎসর–
দেবী। সে বিষয়ে আমার মত ফিরিতেছে। আমি আপনার কথায় এত দিন ভুলিয়াছিলাম–আর ভুলিব না। পরদ্রব্য কাড়িয়া লওয়া মন্দ কাজ নয় ত মহাপাতক কি? আপনাদের সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধই রাখিব না।
ভ। সে কি? যা এতদিন বুঝাইয়া দিয়াছি, তাই কি আবার তোমায় বুঝাইতে হইবে?যদি আমি এ সকল ডাকাইতির ধনের এক কপর্দক গ্রহণ করিতাম, তবে মহাপাতক বটে। কিন্তু তুমি ত জান যে, কেবল পরকে দিবার জন্য ডাকাইতি করি। যে ধার্মিক, যে সৎপথে থাকিয়া ধন উপার্জন করে, যাহার ধনহানি হইলে ভরণপোষণের কষ্ট হইবে, রঙ্গরাজ কি আমি কখন তাহাদের এক পয়সাও লই নাই। যে জুয়াচোর, দাগাবাজ, পরের ধন কাড়িয়া বা ফাঁকি দিয়া লইয়াছে, আমরা তাহাদের উপর ডাকাইতি করি। করিয়া এক পয়সাও লই নাই, যাহার ধন বঞ্চকেরা লইয়াছিল, তাহাকেই ডাকিয়া দিই। এ সকল কি তুমি জান না? দেশ অরাজক, দেশে রাজশাসন নাই, দুষ্টের দমন নাই, যে যার পায়, কাড়িয়া খায়। আমরা তাই তোমায় রাণী করিয়া রাজশাসন চালাইতেছি। তোমার নামে আমরা দুষ্টের দমন করি, শিষ্টের পালন করি। এ কি অধর্ম?
দেবী। রাজা রাণী, যাকে করিবেন, সেই হইতেই পারিবে। আমাকে অব্যাহতি দিন–আমার এ রাণীগিরিতে আর চিত্ত নাই।
ভ। আর কাহাকেও এ রাজ্য সাজে না। আর কাহারও অতুল ঐশ্বর্য নাই–তোমার ধনদানে সকলেই তোমার বশ।
দেবী। আমার যে ধন আছে, সকলই আমি আপনাকে দিতেছি। আমি ঐ টাকা যেরূপে খরচ করিতাম, আপনিও সেইরূপে করিবেন। আমি কাশী গিয়া বাস করিব, মানস করিয়াছি।
ভ। কেবল তোমার ধনেই কি সকলে তোমার বশ? তুমি রূপে যথার্থ রাজরাণী–গুণে যথার্থ রাজরাণী। অনেকে তোমাকে সাক্ষাৎ ভগবতী বলিয়া জানে–কেন না, তুমি সন্ন্যাসিনী, মার মত পরের মঙ্গল কামনা কর, অকাতরে ধন দান কর, আবার ভগবতীর মত রূপবতী। তাই আমরা তোমার নামে এ রাজ্য শাসন করি–নহিলে আমাদের কে মানিত?
দেবী। তাই লোকে আমাকে ডাকাইতনী বলিয়া জানে–এ অখ্যাতি মরিলেও যাবে না।
ভ। অখ্যাতি কি? এ বরেন্দ্রভূমে আজি কালি কে এমন আছে যে, এ নামে লজ্জিত? কিন্তু সে কথা যাক–ধর্মাচরণে সুখ্যাতি খুঁজিবার দরকার কি? খ্যাতির কামনা করিলেই কর্ম আর নিষ্কাম হইল কৈ? তুমি যদি অখ্যাতির ভয় কর, তবে তুমি আপনার খুঁজিলে, পরের ভাবিলে না। আত্মবিসর্জন হইল কৈ?
দেবী। আপনাকে আমি তর্কে আঁটিয়া উঠিতে পারিব না–আপনি মহামহোপাধ্যায়, –আমার স্ত্রীবুদ্ধিতে যাহা আসিতেছে, তাই বলিতেছি–আমি এ রাণীগিরি হইতে অবসর হইতে চাই। আমার এ আর ভাল লাগে না।
ভ। যদি ভাল লাগে না–তবে কালি রঙ্গরাজকে ডাকাইতি করিতে পাঠাইয়াছিলে কেন? কথা যে আমার অবিদিত নাই, তাহা বলা বেশীর ভাগ।
দেবী। কথা যদি অবিদিত নাই, তবে অবশ্য এটাও জানেন যে, কাল রঙ্গরাজ ডাকাইতি করে নাই–ডাকাইতির ভাণ করিয়াছিল মাত্র।
ভ। কেন? তা আমি জানি না, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি।
দেবী। একটা লোককে ধরিয়া আনিবার জন্য।