মৃণালিনী
গিরিজায়া তখন প্রণাম করিয়া কপট বিদায়ের উদ্যোগ করিল। গমনকালে হেমচন্দ্র তাহাকে কহিলেন, “গিরিজায়া, তুমি হাসিতেছ না, কিন্তু তোমার চক্ষু হাসিতেছে। আজি কি তোমার গান শুনিয়া কেহ কিছু বলিয়াছে?”
গি। কে কি বলিবে? এক মাগী তাড়া করিয়া মারিতে আসিয়াছিল- বলে মথুরাবাসিনীর জন্যে শ্যামসুন্দরের ত মাথাব্যথা পড়িয়াছে।
হেমচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অস্ফুটস্বরে, যেন আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন “এত যত্নেও যদি সন্ধান না পাইলাম, তবে আর বৃথা আশা- কেন মিছা কালক্ষেপ করিয়া আত্মকর্ম নষ্ট করি; গিরিজায়ে, কালি তোমাদিগের নগর হইতে বিদায় হইব |”
“তথাস্তু” বলিয়া গিরিজায়া মৃদু মৃদু গান করিতে লাগিল,-
“শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী, বনে বনে একা রে |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “ও গান এই পর্যন্ত। অন্য গীত গাও |”
গিরিজায়া গায়িল,
“যে ফুল ফুটিত সখি, গৃহতরুশাখে,
কেন রে পবনা, উড়ালি তাকে |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “পবনে যে ফুল উড়ে, তাহার জন্য দু:খ কি? ভাল গীত গাও |”
গিরিজায়া গায়িল,
“কণ্টকে গঠিল, বিধি, মৃণাল অধমে।
জলে তারে ডুবাইল পীড়িয়া মরমে ||”
হে। কি, কি? মৃণাল কি?
গি।
কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে।
জলে তারে ডুবাইল, পীড়িয়া মরমে ||
রাজহংস দেখি এক নয়নরঞ্জন।
চরণ বেড়িয়া তারে করিল বন্ধন ||
না- অন্য গান গাই।
হে। না- না -না- এই গান- এই গান গাও। তুমি রাক্ষসী।
গি।
বলে হংসরাজ কোথা করিবে গমন।
হৃদয়কমলে দিব তোমার আসন ||
আসিয়া বসিল হংস হৃদয়কমলে।
কাঁপিল কণ্টকসহ মৃণালিনী জলে ||
হে। গিরিজায়া! গিরি- এ গীত তোমাকে কে শিখাইল?
গি। (সহাস্যে)
হেন কালে কালমেঘ উঠিল আকাশে।
উড়িল মরালরাজ মানস বিলাসে।
ভাঙ্গিল হৃদয়পদ্ম তার বেগভরে।
ডুবিয়া অতল জলে মৃণালিনী মরে ||