সীতারাম
অষ্টম পরিচ্ছেদ
অনেক দিন পরে, শ্রী ও জয়ন্তী বিরূপাতীরে, ললিতগিরির উপত্যকায় আসিয়াছে। মহাপুরুষ আসিতে বলিয়াছিলেন, পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে। তাই, দুই জনে আসিয়া উপস্থিত।
মহাপুরুষ কেবল জয়ন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন-শ্রীর সঙ্গে নহে। জয়ন্তী একা হস্তিগুম্ফামধ্যে প্রবেশ করিল,-শ্রী ততক্ষণে বিরূপাতীরে বেড়াইতে লাগিল। পরে, শিখরদেশে আরোহণ করিয়া, চন্দনবৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া, নিম্নে ভূতলস্থ নদীতীরের এক তালবনের অপূর্ব শোভা দর্শন করিতে লাগিল। পরে জয়ন্তী ফিরিয়া আসিল।
মহাপুরুষ কি আদেশ করিলেন, জয়ন্তীকে না জিজ্ঞাসা করিয়া শ্রী বলিল, “কি মিষ্ট পাখীর শব্দ! কান ভরিয়া গেল!”
জয়ন্তী। স্বামীর কণ্ঠস্বরের তুল্য কি?
শ্রী। এই নদীর তর-তর গদ-গদ শব্দের তুল্য।
জয়ন্তী। স্বামীর কণ্ঠস্বরের তুল্য কি?
শ্রী। অনেক দিন স্বামীর কণ্ঠ শুনি নাই-বড় আর মনে নাই।
হায়! সীতারাম!
জয়ন্তী তাহা জানিত, মনে করাইবার জন্য সে কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। জয়ন্তী বলিল, “এখন শুনিলে আর তেমন ভাল লাগিবে না কি?”
শ্রী চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিয়া, জয়ন্তীর পানে চাহিয়া শ্রী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, ঠাকুর কি আমাকে পতিসন্দর্শনে যাইতে অনুমতি করিয়াছেন?”
জ। তোমাকে ত যাইতেই হইবে-আমাকেও তোমার সঙ্গে যাইতে বলিয়াছেন।
শ্রী। কেন?
জ। তিনি বলেন, শুভ হইবে।
শ্রী। এখন আর তাহাতে শুভাশুভ, সুখদুঃখ কি ভগিনি?
জ। বুঝিতে পারিলে না কি শ্রী? তোমায় আজিও কি এত বুঝাইতে হইবে?
শ্রী। না-বুঝি নাই।
জ। তোমার শুভাশুভ উদ্দিষ্ট হইলে, ঠাকুর তোমাকে কোন আদেশ করিতেন না- আপনার স্বার্থ খুঁজিতে তিনি কাহাকেও আদেশ করেন না। ইহাতে তোমার শুভাশুভ কিছুই নাই।
শ্রী। বুঝিয়াছি-আমি এখন গেলে আমার স্বামীর শুভ হইবার সম্ভাবনা?
জ। তিনি কিছুই স্পষ্ট বলেন না-অত ভাঙ্গিয়াও বলেন না, আমাদিগের সঙ্গে বেশী কথা কহিতে চাহেন না। তবে তাঁহার কথা এইমাত্র তাৎপর্য্য হইতে পারে, ইহা আমি বুঝি। আর তুমিও আমার কাছে এত দিন যাহা শুনিলে শিখিলে, তাহাতে তুমিও বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ।
শ্রী। তুমি যাইবে কেন?
জ। তাহা আমাকে কিছুই বলেন নাই। তিনি আজ্ঞা করিয়াছেন, তাই আমি যাইব। না যাইব কেন? তুমি যাইবে?
শ্রী। তাই ভাবিতেছি।
জ। ভাবিতেছ কেন? সেই প্রিয়প্রাণহন্ত্রী কথাটা মনে পড়িয়াছে বলিয়া কি?
শ্রী। না। এখন আর তাহাতে ভীত নই।