কৃষ্ণকান্তের উইল
অকস্মাৎ সেই অন্ধকার, স্তব্ধ বিজন মধ্যে গোবিন্দলালের উন্মাদগ্রস্ত চিত্ত বিষম বিকার প্রাপ্ত হইল। তিনি স্পষ্টাক্ষরে কণ্ঠস্বর শুনিলেন। রোহিণী উচ্চৈঃস্বরে যেন বলিতেছে,
“এইখানে!”
গোবিন্দলালের তখন আর স্মরণ ছিল না যে, রোহিণী মরিয়াছে। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এইখানে–কি?”
যেন শুনিলেন, রোহিণী বলিতেছে–
“এমনি সময়ে!”
গোবিন্দলাল কলে বলিলেন, “এইখানে, এমনি সময়ে, কি রোহিণী?”
মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত গোবিন্দলাল শুনিলেন, আবার রোহিণী উত্তর করিল, “এইখানে, এমনি সময়ে ঐ জলে,
“আমি ডুবিয়াছিলাম!”
গোবিন্দলাল আপন মানসোদ্ভূত এই বাণী শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি ডুবিব?”
আবার ব্যাধিজনিত উত্তর শুনিলেন, “হাঁ, আইস। ভ্রমর স্বর্গে বসিয়া বলিয়া পাঠাইতেছে, তাহার পুণ্যবলে আমাদিগকে উদ্ধার করিবে। প্রায়শ্চিত্ত কর। মর |”
গোবিন্দলাল চক্ষু বুজিলেন। তাঁহার শরীর অবসন্ন, বেপমান হইল। তিনি মূর্ছিত হইয়া সোপানশিলার উপরে পতিত হইলেন।
মুগ্ধাবস্থায়, মানস চক্ষে দেখিলেন, সহসা রোহিণীমূর্তি অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। তখন দিগন্ত ক্রমশ: প্রভাসিত করিয়া জ্যোতির্ময়ী ভ্রমরমূর্তি সম্মুখে উদিত হইল।
ভ্রমরমূর্তি বলিল, “মরিবে কেন? মরিও না। আমাকে হারাইয়াছ, তাই মরিবে? আমার অপেক্ষাও প্রিয় কেহ আছেন। বাঁচিলে তাঁহাকে পাইবে |”
গোবিন্দলাল সে রাত্রে মূর্ছিত অবস্থায় সেখানে পড়িয়া রহিলেন। প্রভাতে সন্ধান পাইয়া তাঁহার লোকজন তাঁহাকে তুলিয়া গৃহে লইয়া গেল। তাঁহার দূরবস্থা দেখিয়া মাধবীনাথেরও দয়া হইল। সকলে মিলিয়া তাঁহার চিকিৎসা করাইলেন। দুই তিন মাসে গোবিন্দলাল প্রকৃতিস্থ হইলেন। সকলেই প্রত্যাশা করিতে লাগিলেন যে, তিনি এক্ষণে গৃহে বাস করিবেন। কিন্তু গোবিন্দলাল তাহা করিলেন না। এক রাত্রি তিনি কাহাকে কিছু না বলিয়া কোথায় চলিয়া গেলেন। কেহ আর তাঁহার কোন সংবাদ পাইল না।
সাত বৎসরের পর, তাঁহার শ্রাদ্ধ হইল।