কৃষ্ণকান্তের উইল
আমরা জানি না যে, সে রাত্রি গোবিন্দলাল কি প্রকারে কাটাইয়াছিলেন। বোধ হয় রাত্রি বড় ভয়ানকই গিয়াছিল। দ্বার খুলিয়াই মাধবীনাথের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। মাধবীনাথ তাঁহাকে দেখিয়া, মুখপানে চাহিয়া রহিলেন–মুখে মনুষ্যের সাধ্যাতীত রোগের ছায়া।
মাধবীনাথ তাঁহার সঙ্গে কথা কহিলেন না–মাধবীনাথ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ইহজন্মে আর গোবিন্দলালের সঙ্গে কথা কহিবেন না। বিনাবাক্যে মাধবীনাথ চলিয়া গেলেন।
গোবিন্দলাল গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া ভ্রমরের শয্যাগৃহতলস্থ সেই পুষ্পোদ্যানে গেলেন। যামিনী যথার্থই বলিয়াছেন, সেখানে আর পুষ্পোদ্যান নাই। সকলই ঘাস খড় ও জঙ্গলে পুরিয়া গিয়াছে–দুই একটি অমর পুষ্পবৃক্ষ সেই জঙ্গলের মধ্যে অর্ধমৃতবৎ আছে–কিন্তু তাহাতে আর ফুল ফুটে না। গোবিন্দলাল অনেক্ষণ সেই খড়বনের মধ্যে বেড়াইলেন। অনেক বেলা হইল–রৌদ্রের অত্যন্ত তেজ: হইল–গোবিন্দলাল বেড়াইয়া বেড়াইয়া শ্রান্ত হইয়া শেষে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
তথা হইতে গোবিন্দলাল কাহারও সঙ্গে বাক্যালাপ না করিয়া, কাহারও মুখপানে না চাহিয়া বারুণী-পুষ্করিণী-তটে গেলেন। বেলা দেড় প্রহর হইয়াছে। তীব্র রৌদ্রের তেজে বারুণীর গভীর কৃষ্ণজ্জ্বল বারিরাশি জ্বলিতেছিল–স্ত্রী পুরুষ বহুসংখ্যক লোক ঘাটে স্নান করিতেছিল–ছেলেরা কালো জলে স্ফাটিক চূর্ণ করিতে করিতে সাঁতার দিতেছিল। গোবিন্দলালের তত লোকসমাগম ভাল লাগিল না। ঘাট হইতে যেখানে বারুণীতীরে, তাঁহার সেই নানাপুষ্পরঞ্জিত নন্দনতুল্য পুষ্পোদ্যান ছিল, গোবিন্দলাল সেই দিকে গেলেন। প্রথমেই দেখিলেন, রেলিং ভাঙ্গিয়া গিয়াছে –সেই লৌহনির্মিত বিচিত্র দ্বারের পরিবর্তে কঞ্চির বেড়া। ভ্রমর গোবিন্দলালের জন্য সকল সম্পত্তি যত্নে রক্ষা করিয়াছিলেন, কিন্তু এ উদ্যানের প্রতি কিছুমাত্র যত্ন করেন নাই। একদিন যামিনী সে বাগানের কথা বলিয়াছিলেন–ভ্রমর বলিয়াছিল, “আমি যমের বাড়ী চলিলাম–আমার সে নন্দনকাননও ধ্বংস হউক। দিদি, পৃথিবীতে যা আমার স্বর্গ ছিল–তা আর কাহাকে দিয়া যাইব?”
গোবিন্দলাল দেখিলেন ফটক নাই–রেলিং পড়িয়া আছে। প্রবেশ করিয়া দেখিলেন–ফুলগাছ নাই–কেবল উলুবন, আর কচুগাছ, ঘেঁটু ফুলের গাছ, কালকাসন্দা গাছে বাগান পরিপূর্ন। লতামন্ডপসকল ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে—প্রস্তরমূর্তি সকল দুই তিন খন্ডে বিভক্ত হইয়া ভূমে গড়াগড়ি যাইতেছে–তাহার উপর লতা সকল ব্যাপিয়াছে, কোনটা বা ভগ্নাবস্থায় দণ্ডায়মান আছে। প্রমোদভবনের ছাদ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে; ঝিলমিল শার্সি কে ভাঙ্গিয়া লইয়া গিয়াছে–মর্মরপ্রস্তর সকল কে হর্ম্যতল হইতে খুলিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়াছে–সে বাগানে আর ফুল ফুটে না–ফল ফলে না–বুঝি সুবাতাসও আর বয় না।
একটা ভগ্ন প্রস্তরমূতির পদতলে গোবিন্দলাল বসিলেন। ক্রমে মধ্যাহ্নকাল উপস্থিত হইল, গোবিন্দলাল সেইখানে বসিয়া রহিলেন। প্রচণ্ড সূর্যতেজে তাঁহার মস্তক উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। কিন্তু গোবিন্দলাল কিছুই অনুভব করিলেন না। তাঁহার প্রাণ যায়। রাত্রি অবধি কেবল ভ্রমর ও রোহিণী ভাবিতেছিলেন। একবার ভ্রমর, তার পর রোহিণী, আবার ভ্রমর, আবার রোহিণী। ভাবিতে ভাবিতে চক্ষে ভ্রমরকে দেখিতে লাগিলেন, সম্মুখে রোহিণীকে দেখিতে লাগিলেন। জগৎ ভ্রমর-রোহিণীময় হইয়া উঠিল। সেই উদ্যানে বসিয়া প্রত্যেক বৃক্ষকে ভ্রমর বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিল–প্রত্যেক বৃক্ষছায়ায় রোহিণী বসিয়া আছে দেখিতে লাগিলেন। এই ভ্রমর দাঁড়াইয়াছিল–আর নাই–এই রোহিণী আসিল, আবার কোথায় গেল? প্রতি শব্দে ভ্রমর বা রোহিণীর কণ্ঠ শুনিতে লাগিলেন। ঘাটে স্নানকারীরা কথা কহিতেছে, তাহাতে কখনও বোধ হইল ভ্রমর কথা কহিতেছে–কখনও বোধ হইতে লাগিল রোহিণী কথা কহিতেছে–কখনও বোধ হইল তাহারা দুই জনে কথোপকথন করিতেছে। শুষ্ক পত্র নড়িতেছে–বোধ হইল ভ্রমর আসিতেছে–বনমধ্যে বন কীটপতঙ্গ নড়িতেছে–বোধ হইল রোহিণী পলাইতেছে। বাতাসে শাখা দুলিতেছে–বোধ হইল ভ্রমর নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে–দয়েল ডাকিলে বোধ হইল রোহিণী গান করিতেছে। জগৎ ভ্রমর-রোহিণীময় হইল।
বেলা দুই প্রহর–আড়াই প্রহর হইল–গোবিন্দলাল সেইখানে–সেই ভগ্নপুত্তলপদতলে–সেই ভ্রমর-রোহিণীময় জগতে। বেলা তিন প্রহর, সার্ধ তিন প্রহর হইল–অস্নাত অনাহারী গোবিন্দলাল সেইখানে, সেই ভ্রমর-রোহিণীময় অনলকুণ্ডে। সন্ধ্যা হইল, তথাপি গোবিন্দলালের উত্থান নাই–চৈতন্য নাই। তাঁহার পৌরজনে তাঁহাকে সমস্ত দিন না দেখিয়া মনে করিয়াছিল, তিনি কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তাঁহার অধিক সন্ধান করা নাই। সেইখানে সন্ধ্যা হইল। কাননে অন্ধকার হইল। আকাশে নক্ষত্র ফুটিল। পৃথিবী নীরব হইল। গোবিন্দলাল সেইখানে।