চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : সপ্তম বৎসর

বাস্তবিক ভ্রমরের দিন ফুরাইয়া আসিয়াছিল। অনেক দিন হইতে ভ্রমরের সাংঘাতিক পীড়া চিকিৎসায় উপশমিত ছিল। কিন্তু রোগ আর বড় চিকিৎসা মানিল না। এখন ভ্রমর দিন দিন ক্ষয় হইতে লাগিলেন। অগ্রহায়ণ মাসে ভ্রমর শয্যাশায়িনী হইলেন, আর শয্যাত্যাগ করিয়া উঠেন না। মাধবীনাথ স্বয়ং আসিয়া নিকটে থাকিয়া নিষ্ফল চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন। যামিনী হরিদ্রাগ্রামের বাটীতে আসিয়া ভগিনীর শেষ শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন।

রোগ চিকিৎসা মানিল না। পৌষ মাস এইরূপে গেল। মাঘ মাসে ভ্রমর ঔষধ ব্যবহার পরিত্যাগ করিলেন। ঔষধসেবন এখন বৃথা। যামিনীকে বলিলেন, “আর ঔষধ খাওয়া হইবে না দিদি–সম্মুখে ফাল্গুন মাস–ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার রাত্রে যেন মরি। দেখিস দিদি–যেন ফাল্গুনের পূর্ণিমার রাত্রি পলাইয়া যায় না। যদি দেখিস যে, পূর্ণিমার রাত্রি পার হই–তবে আমায় একটা অন্তরটিপনি দিতে ভুলিস্ না। রোগে হউক, অন্তরটিপনিতে হউক–ফাল্গুনের জ্যোৎস্নারাত্রে মরিতে হইবে। মনে থাকে যেন দিদি |”

যামিনী কাঁদিল, কিন্তু ভ্রমর আর ঔষধ খাইল না। ঔষধ খায় না, রোগের শান্তি নাই–কিন্তু ভ্রমর দিন দিন প্রফুল্লচিত্ত হইতে লাগিল।

এত দিনের পর ভ্রমর আবার হাসি তামাসা আরম্ভ করিল–ছয় বৎসরের পর এই প্রথম হাসি তামাসা। নিবিবার আগে প্রদীপ হাসিল।

যতদিন যাইতে লাগিল–অন্তিম কাল দিনে দিনে যত নিকট হইতে লাগিল–ভ্রমর তত স্থির, প্রফুল্ল হাস্যমূর্তি। শেষে সেই ভয়ঙ্কর শেষ দিন উপস্থিত হইল। ভ্রমর পৌরজনের চাঞ্চল্য এবং যামিনীর কান্না দেখিয়া বুঝিলেন, আজ বুঝি দিন ফুরাইল। শরীরের যন্ত্রণাও সেইরূপ অনুভূত করিলেন। তখন ভ্রমর যামিনীকে বলিলেন,“আজ শেষ দিন|”

যামিনী কাঁদিল। ভ্রমর বলিল, “দিদি–আজ শেষ দিন–আমার কিছু ভিক্ষা আছে–কথা রাখিও|”

যামিনী কাঁদিতে লাগিল–কথা কহিল না।

ভ্রমর বলিল, “আমার এক ভিক্ষা; আজ কাঁদিও না।-আমি মরিলে পর কাঁদিও –আমি বারণ করিতে আসিব না–কিন্তু আজ তোমাদের সঙ্গে কথা কইতে পারি, নির্বিঘ্নে কহিয়া মরিব, সাধ করিতেছে|”

যামিনী চক্ষের জল মুছিয়া কাছে বসিল–কিন্তু অবরুদ্ধ বাষ্পে আর কথা কহিতে পারিল না।

ভ্রমর বলিতে লাগিল, “আর একটা ভিক্ষা–তুমি ছাড়া আর কেহ এখানে না আসে। সময়ে সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিব–কিন্তু এখন আর কেহ না আসে। তোমার সঙ্গে আর কথা কহিতে পাব না|”

যামিনী আর কতক্ষণ কান্না রাখিবে?
ক্রমে রাত্রি হইতে লাগিল। ভ্রমর জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, রাত্রি কি জ্যোৎস্না?”

যামিনী জানেলা খুলিয়া দেখিয়া বলিল, “দিব্য জ্যোৎস্না উঠিয়াছে|”

ভ্র। তবে জানেলাগুলি সব খুলিয়া দাও–আমি জ্যোৎস্না দেখিয়া মরি। দেখ দেখি, ঐ জানেলার নীচে যে ফুলবাগান, উহাতে ফুল ফুটিয়াছে কি না?

সেই জানেলায় দাঁড়াইয়া প্রভাতকালে ভ্রমর, গোবিন্দলালের সঙ্গে কথোপকথন করিতেন। আজি সাত বৎসর ভ্রমর সে জানেলার দিকে যান নাই–সে জানেলা খোলেন নাই।

যামিনী কষ্টে সেই জানেলা খুলিয়া বলিল, “কই, এখানে ত ফুলবাগান নাই–এখানে কেবল খড়বন–আর দুই-একটা মরা মরা গাছ আছে–তাতে ফুল পাতা নাই|”