কৃষ্ণকান্তের উইল
মাধবীনাথ আদৌ তামাকু খান না–কেবল হরিদাস বাবাজিকে বিদায় করিবার জন্য তামাকুর ফরমায়েশ করিলেন।
পিয়াদা মহাশয় স্থানান্তরে গমন করিলে, মাধবীনাথ পোষ্টমাষ্টার বাবুকে বলিলেন, “আপনার কাছে একটা জিজ্ঞাসা করার জন্য আসা হইয়াছে |”
পোষ্টমাষ্টার বাবু মনে মনে একটু হাসিলেন। তিনি বঙ্গদেশীয়–নিবাস বিক্রমপুরে। অন্য দিকে যেমন নির্বোধ হউন না কেন–আপনার কাজ বুঝিতে সূচ্যগ্রবুদ্ধি। বুঝিলেন যে, বাবুটি কোন বিষয়ের সন্ধানে আসিয়াছেন। বলিলেন, “কি কথা মহাশয়?”
মা। ব্রহ্মানন্দকে আপনি চিনেন?
পো। চিনি না–চিনি–ভাল চিনি না।
মাধবীনাথ বুঝিলেন, অবতার নিজমূর্তি ধারণ করিবার উপক্রম করিতেছে। বলিলেন, “আপনার ডাকঘরে ব্রহ্মানন্দ ঘোষের নামে কোন পত্রাদি আসিয়া থাকে?”
পো। আপনার সঙ্গে ব্রহ্মানন্দ ঘোষের আলাপ নাই?
মা। থাক বা না থাক, কথাটা জিজ্ঞাসা করিতে আপনার কাছে আসিয়াছি।
পোষ্টমাষ্টার বাবু তখন আপনার উচ্চ পদ এবং ডিপুটি অভিধান স্মরণপূর্বক অতিশয় গম্ভীর হইয়া বসিলেন, এবং অল্প রুষ্টভাবে বলিলেন, “ডাকঘরের খবর আমাদের বলিতে বারণ আছে|” ইহা বলিয়া পোষ্ট মাষ্টার নীরবে চিঠি ওজন করিতে লাগিলেন।
মাধবীনাথ মনে মনে হাসিতে লাগিলেন; প্রকাশ্যে বলিলেন, “ওহে বাপু, তুমি অমনি কথা কবে না, তা জানি। সে জন্য কিছু সঙ্গেও আনিয়াছি–কিছু দিয়া যাইব–এখন যা যা জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক বল দেখি___”
তখন, পোষ্ট বাবু হর্ষোৎফুল্ল বদনে বলিলেন, “কি কন?”
মা। কই এই, ব্রহ্মানন্দের নামে কোন চিঠিপত্র ডাকঘরে আসিয়া থাকে?
পো। আসে।
মা। কত দিন অন্তর?
পো। যে কথাটি বলিয়া দিলাম, তাহার এখনও টাকা পাই নাই। আগে তার টাকা বাহির করুন; তবে নূতন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন।
মাধবীনাথের ইচ্ছা ছিল, পোষ্টমাষ্টারকে কিছু দিয়া যান। কিন্তু তাহার চরিত্রে বড় বিরক্ত হইয়া উঠিলেন–বলিলেন, “বাপু, তুমি ত বিদেশী মানুষ দেখছি–আমায় চেন কি?”
পোষ্ট মাষ্টার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না। তা আপনি যেই হউন না কেন–আমরা কি পোষ্ট আপিসের খবর যাকে তাকে বলি? কে তুমি?”
মা। আমার নাম মাধবীনাথ সরকার–বাড়ী রাজগ্রাম। আমার পাল্লায় কত লাঠিয়াল আছে খবর রাখ?
পোষ্ট বাবুর ভয় হইল–মাধবী বাবুর নাম ও দোর্দণ্ড প্রতাপ শুনিয়াছিলেন। পোষ্টবাবু একটু চুপ করিলেন।
মাধবীনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি যাহা তোমায় জিজ্ঞাসা করি–সত্য সত্য জবাব দাও। কিছু তঞ্চক করিও না। করিলে তোমায় কিছু দিব না–এক পয়সাও নহে। কিন্তু যদি না বল, মিছা বল, তবে তোমার ঘরে আগুন দিব, তোমার ডাকঘর লুঠ করিব; আদালতে প্রমাণ করাইব যে, তুমি নিজে লোক দিয়া সরকারী টাকা অপহরণ করিয়াছ–কেমন, এখন বলিবে?”