কৃষ্ণকান্তের উইল
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মাধবীনাথ কন্যার দুর্দশা দেখিয়া স্থির প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ইহার প্রতীকার করিবেন। গোবিন্দলাল ও রোহিণী এই অনিষ্টের মূল। অতএব প্রথমেই সন্ধান কর্তব্য, সেই পামর পামরী কোথায় আছে। নচেৎ দুষ্টের দণ্ড হইবে না–ভ্রমরও মরিবে।
তাহারা একেবারে লুকাইয়াছে। যে সকল সূত্রে তাহাদের ধরিবার সম্ভাবনা, সকলই অবচ্ছিন্ন করিয়াছে; পদচিহ্নমাত্র মুছিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু মাধবীনাথ বলিলেন যে, যদি আমি তাহাদের সন্ধান করিতে না পারি, তবে বৃথায় আমার পৌরুষের শ্লাঘা করি।
এইরূপ স্থির সংকল্প করিয়া মাধবীনাথ একাকী রায়দিগের বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। হরিদ্রাগ্রমের একটি পোষ্ট আপিস ছিল; মাধবীনাথ বেত্রহস্তে, হেলিতে দুলিতে, পান চিবাইতে চিবাইতে, ধীরে ধীরে, নিরীহ ভালমানুষের মত, সেইখানে গিয়া দর্শন দিলেন।
ডাকঘরে, অন্ধকার চালাঘরের মধ্যে মাসিক পনর টাকা বেতনভাগী একটি ডিপুটি পোষ্ট মাষ্টার বিরাজ করিতেছিলেন। একটি আম্রকাষ্ঠের ভগ্ন টেবিলের উপরে কতকগুলি চিঠি, চিঠির ফাইল, চিঠির খাম, একখানি খুরিতে কতকটা জিউলির আটা, একটি নিক্তি, ডাকঘরের মোহর ইত্যাদি লইয়া, পোষ্ট মাষ্টার ওরফে পোষ্টবাবু গম্ভীরভাবে, পিয়ন মহাশয়ের নিকট আপন প্রভুত্ব বিস্তার করিতেছেন। ডিপুটি পোষ্টমাষ্টার বাবু পান পনর টাকা, পিয়ন পায় সাত টাকা। সুতরাং পিয়ন মনে করে, সাত আনা আর পনর আনায় যে তফাৎ, বাবুর সঙ্গে আমার সঙ্গে তাহার অধিক তফাৎ নহে। কিন্তু বাবু মনে মনে জানেন যে, আমি একটা ডিপুটি–ও বেটা পিয়াদা–আমি উহার হর্তা কর্তা বিধাতা পুরুষ–উহাতে আমাতে জমীন আশমান ফারাক। সেই কথা সপ্রমাণ করিবার জন্য, পোষ্ট মাষ্টার বাবু সর্বদা সে গরীবকে তর্জন গর্জন করিয়া থাকেন–সেও সাত আনার ওজনে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন, এমত সময়ে প্রশান্তমূতি সহাস্যবদন মাধবীনাথ বাবু সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভদ্রলোক দেখিয়া, পোষ্টমাষ্টার বাবু, আপাততঃ পিয়াদার সঙ্গে কচকচি বন্ধ করিয়া, হাঁ করিয়া, চাহিয়া রহিলেন। ভদ্রলোককে সমাদর করিতে হয়, এমন কতকটা তাঁহার মনে উদয় হইল–কিন্তু সমাদর কি প্রকারে করিতে হয়, তাহা তাঁহার শিক্ষার মধ্যে নহে–সুতরাং তাহা ঘটিয়া উঠিল না।
মাধবীনাথ দেখিলেন, একটা বানর। সহাস্যবদনে বলিলেন, “ব্রাহ্মণ?”
পোষ্টমাষ্টার বলিলেন, “হাঁ–তু–তুমি–আপনি?”
মাধবীনাথ ঈষৎ হাস্য সংবরণ করিয়া অবনতশিরে যুক্তকরে ললাট স্পর্শ করিয়া বলিলেন, “প্রাতঃপ্রণাম!”
তখন পোষ্ট মাষ্টার বাবু বলিলেন, “বসুন |”
মাধবীনাথ কিছু বিপদে পড়িলেন;-পোষ্টবাবু ত বলিলেন, “বসুন”, কিন্তু তিনি বসেন কোথা–বাবু খোদ এক অতি প্রাচীন ত্রিপাদমাত্রবশিষ্ট চৌকিতে বসিয়া আছেন–তাহা ভিন্ন আর আসন কোথাও নাই। তখন সেই পোষ্টমাষ্টার বাবুর সাত আনা, হরিদাস পিয়াদা–একটা ভাঙ্গা টুলের উপর হইতে রাশিখানি ছেঁড়া বহি নামাইয়া রাখিয়া মাধবীনাথকে বসিতে দিল। মাধবীনাথ বসিয়া তাহার প্রতি দৃষ্টি করিয়া বলিলেন, “কি হে বাপু, কেমন আছ? তোমাকে দেখিয়াছি না?”
পিয়াদা। আজ্ঞা, আমি চিঠি বিলি করিয়া থাকি।
মাধবী। তাই চিনিতেছি। এক ছিলিম তামুক সাজ দেখি–
মাধবীনাথ গ্রামান্তরের লোক, তিনি কখনই হরিদাস বৈরাগী পিয়াদাকে দেখেন নাই এবং বৈরাগী বাবাজিও কখনও তাহাকে দেখেন নাই। বাবাজি মনে করিলেন–বাবুটা রকমসই বটে চাহিলে কোন না চারি গণ্ডা বখশিশ দিবে। এই ভাবিয়া হুঁকোর তল্লাসে ধাবিত হইলেন।