কৃষ্ণকান্তের উইল
গো। আছে না ত কি? সর্বে সর্বময়ী আর কি! আমি অন্য মানুষ ভাবতেছি।
ভ্রমর তখন গোবিন্দলালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া, মুখচুম্বন করিয়া, আদরে গলিয়া গিয়া, আধো আধো, মৃদু মৃদু হাসিমাখা স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্য মানুষ–কাকে ভাব্দছ বল না?”
গো। কি হবে তোমায় বলিয়া?
ভ্র। বল না!
গো। তুমি রাগ করিবে।
ভ্র। করি কর্ বো–বল না।
গো। যাও, দেখ গিয়া সকলের খাওয়া হলো কি না।
ভ্র। দেখ্কবো এখন–বল না কে মানুষ?
গো। সিয়াকুল কাঁটা! রোহিণীকে ভাবছিলাম।
ভ্র। কেন রোহিণীকে ভাবছিলে?
গো। তা কি জানি?
ভ্র। জান–বল না।
গো। মানুষ কি মানুষকে ভাবে না?
ভ্র। না। যে যাকে ভালবাসে, সে তাকেই ভাবে, আমি তোমাকে ভাবি–তুমি আমাকে ভাব।
গো। তবে আমি রোহিণীকে ভালবাসি।
ভ্র। মিছে কথা–তুমি আমাকে ভালবাস–আর কাকেও তোমার ভালবাস্লতে নাই–কেন রোহিণীকে ভাব্নছিলে বল না?
গো। বিধবাকে মাছ খাইতে আছে?
ভ্র। না।
গো। বিধবাকে মাছ খাইতে নাই, তবু তারিণীর মা মাছ খায় কেন?
ভ্র। তার পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করে।
গো। আমারও পোড়ার মুখ, যা করতে নাই, তাই করি। রোহিণীকে ভালবাসি।
ধা করিয়া গোবিন্দলালের গালে ভোমরা এক ঠোনা মারিল। বড় রাগ করিয়া বলিল, “আমি শ্রীমতী ভোমরা দাসী–আমার সাক্ষাতে মিছে কথা?”
গোবিন্দলাল হারি মানিল। ভ্রমরের স্কন্ধে হস্ত আরোপিত করিয়া, প্রফুল্লনীলোৎপলদলতুল্য মধুরিমাময় তাহার মুখমণ্ডল স্বকরপল্লবে গ্রহণ করিয়া, মৃদু মৃদু অথচ গম্ভীর, কাতর কণ্ঠে গোবিন্দলাল বলিল, “মিছে কথাই ভোমরা। আমি রোহিণীকে ভালবাসি না। রোহিণী আমায় ভালবাসে |”
তীব্র বেগে গোবিন্দলালের হাত হইতে মুখমণ্ডল মুক্ত করিয়া, ভোমরা দূরে গিয়া, দাঁড়াইল। হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিতে লাগিল, “-আবাগী–পোড়ারমুখী–বাঁদরী মরুক! মরুক! মরুক! মরুক! মরুক!”
গোবিন্দলাল হাসিয়া বলিলেন, “এখনই এত গালি কেন? তোমার সাত রাজার ধন এক মাণিক এখনও ত কেড়ে নেয় নি |”
ভোমরা একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, “দূর তা কেন–তা কি পারে–তা মাগী তোমার সাক্ষাতে বলিল কেন?”
গো। ঠিক ভোমরা–বলা তাহার উচিত ছিল না–তাই ভাবিতেছিলাম। আমি তাহাকে বাস উঠাইয়া কলিকাতায় গিয়া বাস করিতে বলিয়াছিলাম–খরচ পর্যন্ত দিতে স্বীকার করিয়াছিলাম।