চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

রোহিণী, গোবিন্দলালের অনুমতিক্রমে খুড়ার সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার বন্দোবস্ত করিতে আসিল। খুড়াকে কিছু না বলিয়া, ঘরের মধ্যস্থলে বসিয়া পড়িয়া, রোহিণী কাঁদিতে বসিল।

“এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া আমার যাওয়া হইবে না–না দেখিয়া মরিয়া যাইব। আমি কলিকাতায় গেলে, গোবিন্দলালকে দেখিতে পাইব না? আমি যাইব না। এই হরিদ্রাগ্রাম আমার স্বর্গ, এখানে গোবিন্দলালের মন্দির। এই হরিদ্রাগ্রামই আমার শ্মশান, এখানে আমি পুড়িয়া মরিব। শ্মশানে মরিতে পায় না, এমন কপালও আছে। আমি যদি এ হরিদ্রাগ্রাম ছাড়িয়া না যাই, ত আমার কে কি করিতে পারে? কৃষ্ণকান্ত রায় আমার মাথা মুড়াইয়া, ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবে? আমি আবার আসিব। গোবিন্দলাল রাগ করিবে? করে করুক,-তবু আমি তাহাকে দেখিব। আমার চক্ষু ত কাড়িয়া লইতে পারিবে না। আমি যাব না। কলিকাতায় যাব না–কোথাও যাব না। যাই ত যমের বাড়ী যাব। আর কোথাও না |”

এই সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া, কালামুখী রোহিণী উঠিয়া দ্বার খুলিয়া আবার–“পতঙ্গবদ্বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ”–সেই গোবিন্দলালের কাছে চলিল। মনে মনে নিতান্ত দুঃখিনী, নিতান্ত দুঃখে পড়িয়াছি–আমায় রক্ষা কর–আমার হৃদয়ের এই অসহ্য প্রেমবহ্নি নিবাইয়া দাও–আর আমায় পোড়াইও না। আমি যাহাকে দেখিতে যাইতেছি–তাহাকে যত বার দেখিব, ততবার–আমার অসহ্য যন্ত্রণা–অনন্ত সুখ। আমি বিধবা–আমার ধর্ম গেল–সুখ গেল–প্রাণ গেল–রহিল কি প্রভু? রাখিব কি প্রভু?–হে দেবতা! হে দুর্গা–হে কালি–হে জগন্নাথ–আমায় সুমতি দাও–আমার প্রাণ স্থির কর–আমি এই যন্ত্রণা আর সহিতে পারি না |”

তবু সেই স্ফীত, হৃত, অপরিমিত প্রেমপরিপূর্ণ হৃদয়–থামিল না। কখনও ভাবিল, গরল খাই; কখনও ভাবিল, গোবিন্দলালের পদপ্রান্তে পড়িয়া, অন্তঃকরণ মুক্ত করিয়া সকল কথা বলি; কখনও ভাবিল, পলাইয়া যাই; কখনও ভাবিল, বারুণীতে ডুবে মরি; কখনও ভাবিল ধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া গোবিন্দলালকে কাড়িয়া লইয়া দেশান্তরে পলাইয়া যাই। রোহিণী কাঁদিতে কাঁদিতে গোবিন্দলালের কাছে পুর্নবার উপস্থিত হইল।

গোবিন্দলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন? কলিকাতায় যাওয়া স্থির হইল ত?”

রো। না।

গো। সে কি? এইমাত্র আমার কাছে স্বীকার করিয়াছিলে?

রো। যাইতে পারিব না।

গো। বলিতে পারি না। জোর করিবার আমার কোনই অধিকার নাই–কিন্তু গেলে ভাল হইত।

রো। কিসে ভাল হইত?

গোবিন্দলাল অধোবদন হইলেন। স্পষ্ট করিয়া কোন কথা বলিবার তিনি কে?”

রোহিণী চক্ষের জল লুকাইয়া মুছিতে মুছিতে গৃহে ফিরিয়া গেল। গোবিন্দলাল নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। তখন ভোমরা নাচিতে নাচিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, “ভাব‍ছ কি?”

গো। বল দেখি।

ভ্র। আমার কালো রূপ।

গো। ইঃ-

ভোমরা ঘোরতর কোপাবিষ্ট হইয়া বলিল, “সে কি? আমায় ভাব্ছ না? আমি ছাড়া, পৃথিবীতে তোমার অন্য চিন্তা আছে?”