কৃষ্ণকান্তের উইল
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
গোবিন্দলাল অন্তঃপুরে আসিয়া দেখিলেন যে, ভ্রমর, রোহিণীকে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাল কথা বলিবার ইচ্ছা, কিন্তু পাছে এ দায় সম্বন্ধে ভাল কথা বলিলেও রোহিণীর কান্না আসে, এ জন্য তাহাও বলিতে পারিতেছে না। গোবিন্দলাল আসিলেন দেখিয়া ভ্রমর যেন দায় হইতে উদ্ধার পাইল। শীঘ্রগতি দূরে গিয়া গোবিন্দলালকে ইঙ্গিত করিয়া ডাকিল। গোবিন্দলাল ভ্রমরের কাছে গেলেন, ভ্রমর গোবিন্দলালকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “রোহিণী এখানে কেন?”
গোবিন্দলাল বলিলেন, “আমি গোপনে উহাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিব। তাহার পর উহার কপালে যা থাকে, হবে|”
ভ্র। কি জিজ্ঞেস করিবে?
গো। উহার মনের কথা। আমাকে উহার কাছে একা রাখিতে যাইতে যদি তোমার ভয় হয়, তবে না হয়, আড়াল হইতে শুনিও।
ভোমরা বড় অপ্রতিভ হইল। লজ্জায় অধোমুখী হইয়া, ছুটিয়া সে অঞ্চল হইতে পলাইল। একেবারে পাকশালায় উপস্থিত হইয়া, পিছন হইতে পাচিকার চুল ধরিয়া টানিয়া বলিল, “রাঁধুনি ঠাকুরঝি! রাঁধতে রাঁধতে একটি রূপকথা বল না |”
এ দিকে গোবিন্দলাল, রোহিণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বৃত্তান্ত আমাকে সকল বিশেষ করিয়া বলিবে কি?” বলিবার জন্য রোহিণীর বুক ফাটিয়া যাইতেছিল–কিন্তু যে জাতি জীয়ন্তে জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করিত, রোহিণীও সেই জাতীয়া–আর্যকন্যা। বলিল, “কর্তার কাছে সবিশেষে শুনিয়াছেন ত!”
গো। কর্তা বলেন, তুমি জাল উইল রাখিয়া, আসল উইল চুরি করিতে আসিয়াছিলে। তাই কি?
রো। তা নয়।
গো। তবে কি?
রো। বলিয়া কি হইবে?
গো। তোমার ভাল হইতে পারে।
রো। আপনি বিশ্বাস করিলে ত?
গো। বিশ্বাসযোগ্য কথা হইলে কেন বিশ্বাস করিব না?
রো। বিশ্বাসযোগ্য কথা নহে।
গো। আমার কাছে কি বিশ্বাসযোগ্য, কি অবিশ্বাসযোগ্য, তাহা আমি জানি, তুমি জানিবে কি প্রকারে? আমি অবিশ্বাসযোগ্য কথাতেও কখনও কখনও বিশ্বাস করি।
রোহিণী মনে মনে বলিল, “নহিলে আমি তোমার জন্যে মরিতে বসিব কেন? যাই হৌক, আমি ত মরিতে বসিয়াছি, কিন্তু তোমায় একবার পরীক্ষা করিয়া মরিব |” প্রকাশ্যে বলিল, “সে আপনার মহিমা। কিন্তু আপনাকে এ দুঃখের কাহিনী বলিয়াই বা কি হইবে?”
গো। যদি আমি তোমার কোন উপকার করিতে পারি।
রো। কি উপকার করিবেন?
গোবিন্দলাল ভাবিলেন, “ইহার জোড়া নাই। যাই হউক, এ কাতরা–ইহাকে সহজে পরিত্যাগ করা নহে|” প্রকাশ্যে বলিলেন, “যদি পারি কর্তাকে অনুরোধ করিব। তিনি তোমায় ত্যাগ করিবেন |”