কৃষ্ণকান্তের উইল
রো। আর যদি আপনি অনুরোধ না করেন, তবে তিনি আমায় কি করিবেন?
গো। শুনিয়াছ ত?
রো। আমার মাথা মুড়াইবেন, ঘোল ঢালিয়া দিবেন, দেশ হইতে বাহির করিয়া দিবেন। ইহার ভাল মন্দ কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।–এ কলঙ্কের পর, দেশ হইতে বাহির করিয়া দিলেই আমার উপকার। আমাকে তাড়াইয়া না দিলে, আমি আপনিই এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইব। আর এ দেশে মুখ দেখাইব কি প্রকারে? ঘোল ঢালা বড় গুরুতর দণ্ড নয়, ধুইলেই ঘোল যাইবে। বাকি এই কেশ–
এই বলিয়া রোহিণী একবার আপনার তরঙ্গক্ষুব্ধ কৃষ্ণতড়াগতুল্য কেশদাম প্রতি দৃষ্টি করিল–বলিতে লাগিল, “এই কেশ–আপনি কাঁচি আনিতে বলুন, আমি বৌ ঠাকরুণের চুলের দড়ি বিনাইবার জন্য ইহার সকলগুলি কাটিয়া দিয়া যাইতেছি |”
গোবিন্দলাল ব্যথিত হইলেন। দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “বুঝেছি রোহিণী। কলঙ্কই তোমার দণ্ড। সে দণ্ড হইতে রক্ষা না হইলে, অন্য দণ্ডে তোমার আপত্তি নাই|”
রোহিণী এবার কাঁদিল। হৃদয়মধ্যে গোবিন্দলালকে শত সহস্র ধন্যবাদ করিতে লাগিল। বলিল, “যদি বুঝিয়াছেন, এ কলঙ্কদণ্ড হইতে কি আমায় রক্ষা করিতে পারিবেন?”
গোবিন্দলাল কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, “বলিতে পারি না। আসল কথা শুনিতে পাইলে, বলিতে পারি যে, পারিব কি না |”
রোহিণী বলিল, “কি জানিতে চাহেন, জিজ্ঞাসা করুন |”
গো। তুমি যাহা পোড়াইয়াছ, তাহা কি?
রো। জাল উইল।
গো। কোথায় পাইয়াছিলে?
রো। কর্তার ঘরে, দেরাজে।
গো। জাল উইল সেখানে কি প্রকারে আসিল?
রো। আমিই রাখিয়া গিয়াছিলাম। যে দিন আসল উইল লেখাপড়া হয়, সেই দিন রাত্রে আসিয়া, আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল রাখিয়া গিয়াছিলাম।
গো। কেন, তোমার কি প্রয়োজন?
রো। হরলাল বাবুর অনুরোধে।
গোবিন্দলাল বলিলেন, “তবে কাল রাত্রে আবার কি করিতে আসিয়াছিলে?”
রো। আসল উইল রাখিয়া, জাল উইল চুরি করিবার জন্য।
গো। কেন? জাল উইলে কি ছিল?
রো। বড় বাবুর বার আনা–আপনার এক পাই।
গো। কেন আবার উইল বদলাইতে আসিয়াছিলে? আমি ত কোন অনুরোধ করি নাই।
রোহিণী কাঁদিতে লাগিল। বহু কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া বলিল, “না–অনুরোধ করেন নাই–কিন্তু যাহা আমি ইহজন্মে কখনও পাই নাই–যাহা ইহজন্মে আর কখনও পাইব না–আপনি আমাকে তাহা দিয়াছিলেন |”
গো। কি সে রোহিণী?
রো। সেই বারুণী পুকুরের তীরে, মনে করুন।
গো। কি রোহিণী?