রজনী
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
বিবাহের দিন অতি নিকট হইল-আর একদিনমাত্র বিলম্ব আছে। উপায় নাই! নিষ্কৃতি নাই! চারিদিক হইতে উচ্ছ্বসিত বারিরাশি গর্জিয়া আসিতেছে-নিশ্চিত ডুবিব।
তখন লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া, মাতার পায়ে আছড়াইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলাম। যোড়হাত করিয়া বলিলাম,-“আমার বিবাহ দিও না-আমি আইবুড়ো থাকিব |”
মা বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?” কেন? তাহার উত্তর দিতে পারিলাম না। কেবল যোড়হাত করিতে লাগিলাম, কেবল কাঁদিতে লাগিলাম। মাতা বিরক্ত হইলেন,-রাগিয়া উঠিলেন; গালি দিলেন। শেষ পিতাকে বলিয়া দিলেন। পিতাও গালি দিয়া মারিতে আসিলেন। আর কিছু বলিতে পারিলাম না।
উপায় নাই! নিষ্কৃতি নাই! ডুবিলাম।
সেই দিন বৈকালে গৃহে কেবল আমি একা ছিলাম-পিতা বিবাহের খরচসংগ্রহে গিয়াছিলেন-মাতা দ্রব্যসামগ্রী কিনিতে গিয়াছিলেন। এ সব যে সময়ে হয়, সে সময়ে আমি দ্বার দিয়া থাকিতাম, না হয় বামাচরণ আমার কাছে বসিয়া থাকিত। বামাচরণ এদিন বসিয়া ছিল। একজন কে দ্বার ঠেলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। চেনা পায়ের শব্দ নহে। জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে গা?”
উত্তর “তোমার যম |”
কথা কোপযুক্ত বটে, কিন্তু স্বর স্ত্রীলোকের। ভয় পাইলাম না। হাসিয়া বলিলাম-“আমার যম কি আছে? তবে এতদিন কোথা ছিলে?”
স্ত্রীলোকটির রাগশান্তি হইল না। “এখন জানবি! বড় বিয়ের সাধ! পোড়ারমুখী ; আবাগী!” ইত্যাদি গালির ছড়া আরম্ভ হইল। গালি সমাপ্তে সেই মধুরভাষিণী বলিলেন, “হাঁ দেখ্, কাণি, যদি আমার স্বামীর সঙ্গে তোর বিয়ে হয়, তবে যেদিন তুই ঘর করিতে যাইবি, সেই দিন তোকে বিষ খাওয়াইয়া মারিব |”
বুঝিলাম, চাঁপা খোদ। আদর করিয়া বসিতে বলিলাম। বলিলাম, “শুন-তোমার সঙ্গে কথা
আছে!” এত গালির উত্তরে সাদর সম্ভাষণ দেখিয়া, চাঁপার একটু শীতল হইয়া বসিল।
আমি বলিলাম, “শুন, এই বিবাহে তুমি যেমন বিরক্ত, আমিও তেমনি। আমার এ বিবাহ যাহাতে না হয়, আমি তাহাই করিতে রাজি আছি। কিসে বিবাহ বন্ধ হয়, তাহার উপায় বলিতে পার?”
চাঁপা বিস্মিত হইল। বলিল, “তা তোমার বাপ-মাকে বল না কেন?”
আমি বলিলাম, “হাজার বার বলিয়াছি। কিছু হয় নাই |”
চাঁ। বাবুদের বাড়ী গিয়া তাঁদের হাতে পায়ে ধর না কেন?
আমি। তাতেও কিছু হয় নাই।
চাঁপা একটু ভাবিয়া বলিল, “তবে এক কাজ করিবি?”
আমি। কি?
চাঁ। দুদিন লুকাইয়া থাকিবি?
আমি। কোথায় লুকাইব? আমার স্থান কোথায় আছে?
চাঁ। আবার একটু ভাবিল। বলিল, “আমার বাপের বাড়ী গিয়া থাকিবি?”
ভাবিলাম, মন্দ কি? আর ত উদ্ধারের কোন উপায় দেখি না। বলিলাম, “আমি কাণা, নূতন স্থানে আমাকে কে পথ চিনাইয়া লইয়া যাইবে? তাহারাই বা স্থান দিবে কেন?”