রজনী
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
চাঁপা আমার সর্বনাশী কুপ্রবৃত্তি মূর্তিমতী হইয়া আসিয়াছিল; সে বলিল, “তোর তা ভাবিতে হইবে না। সে সব বন্দোবস্ত আমি করিব। আমি সঙ্গে লোক দিব, আমি তাদের বলিয়া পাঠাইব। তুই যাস ত বল্?”
মজ্জনোন্মুখের সমীপবর্তী কাষ্ঠফলকবৎ এই প্রবৃত্তি আমার চক্ষে একমাত্র রক্ষার উপায় বলিয়া বোধ হইল। আমি সম্মত হইলাম।
চাঁপা বলিল, “আচ্ছা, তবে ঠিক থাকিস। রাত্রে সবাই ঘুমাইলে আমি আসিয়া দ্বারে টোকা মারিব; বাহির হইয়া আসিস |”
আমি সম্মত হইলাম।
* * *
রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে দ্বারে ঠকঠক করিয়া অল্প শব্দ হইল। আমি জাগ্রত ছিলাম। দ্বিতীয় বস্ত্র মাত্র লইয়া, আমি দ্বারোদ্ঘাটনপূর্বক বাহির হইলাম। বুঝিলাম, চাঁপা দাঁড়াইয়া আছে। তাহার সঙ্গে চলিলাম। একবার ভাবিলাম না-একবার বুঝিলাম না যে, কি দুষ্কর্ম করিতেছি। পিতামাতার জন্য মন কাতর হইল বটে, কিন্তু তখন মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, অল্প দিনের জন্য যাইতেছি। বিবাহের কথা নিবৃত্তি পাইলেই আবার আসিব।
আমি চাঁপার গৃহে-আমার শ্বশুরবাড়ী?-উপস্থিত হইলে চাঁপা আমার সদ্যই লোক সঙ্গে দিয়া বিদায় করিল। পাছে তাহার স্বামী জানিতে পারে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি করিল-যে লোক সঙ্গে দিল, তাহার সঙ্গে যাওয়ার পক্ষে আমার বিশেষ আপত্তি-কিন্তু চাঁপা এমনই তাড়াতাড়ি করিল যে, আমার আপত্তি ভাসিয়া গেল। মনে কর, কাহাকে আমার সঙ্গে দিল? হীরালালকে।
হীরালালের মন্দ চরিত্রের কথা তখন আমি কিছুই জানিতাম না। সে জন্য আপত্তি করি নাই। সে যুবা পুরুষ-আমি যুবতী-তাহার সঙ্গে কি প্রকারে একা যাইব? এই আপত্তি। কিন্তু তখন আমার কথা কে শুনে? আমি অন্ধ, পথ অপরিচিত, রাত্রে আসিয়াছি-সুতরাং পথে যে সকল শব্দঘটিত চিহ্ন আনিয়া রাখিয়া আসিয়া থাকি, সে সকল কিছু শুনিতে পাই নাই-অতএব বিনা সহায়ে বাড়ী ফিরিয়া যাইতে পারিলাম না-বাড়ী ফিরিয়া গেলেও সেই পাপ বিবাহ! অগত্যা হীরালালের সঙ্গে যাইতে হইল। তখন মনে হইল-আর কেহ অন্ধের সহায় থাক না থাক-মাথার উপর দেবতা আছেন; তাঁহারা কখনও লবঙ্গলতার ন্যায় পীড়িতকে পীড়ন করিবেন না; তাঁহাদের দয়া আছে, শক্তি আছে, অবশ্য দয়া করিয়া আমাকে রক্ষ করিবেন-নহিলে দয়া কার জন্য?
তখন জানিতাম না যে, ঐশিক নিয়ম বিচিত্র-মনুষ্যের বুদ্ধির অতীত-আমরা যাহাকে দয়া বলি, ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞানের কাছে তাহা দয়া নহে-আমরা যাহাকে পীড়ন বলি-ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞানের কাছে তাহা পীড়ন নহে। তখন জানিতাম না যে, এই সংসারের অনন্ত চক্র দয়াদাক্ষিণ্যশূন্য, সে চক্র নিয়মিত পথে অনতিক্ষুণ্ণ রেখায় অহরহ চলিতেছে, তাহার দারুণ বেগের পথে যে পড়িবে-অন্ধ হউক, খঞ্জ হউক, আর্ত হউক, সেই পিষিয়া মরিবে। আমি অন্ধ নি:সহায় বলিয়া, অনন্ত সংসারচক্র পথ ছাড়িয়া চলিবে কেন?
হীরালালের সঙ্গে প্রশস্ত রাজপথে বাহির হইলাম-তাহার পদশব্দ অনুসরণ করিয়া চলিলাম-কোথাকার ঘড়িতে একটা বাজিল। পথে কেহ নাই-কোথাও শব্দ নাই-দুই একখানা গাড়ির শব্দ-দুই একজন সুরাপহৃতবুদ্ধি কামিনীর অসম্বদ্ধ গীতিশব্দ। আমি হীরালালকে সহসা জিজ্ঞাসা করিলাম,-“হীরালাল বাবু, আপনার গায়ে জোর কেমন?”
হীরালাল একটু বিস্মিত হইল-বলিল, “কেন?”
আমি বলিলাম, “জিজ্ঞাসা করি |”