জিজ্ঞাসার ভাবেই উত্তর নিবারণ হইল। তথাপি সূর্যমুখী উত্তর করিলেন, “দোষ কি, তাহা ত আমি জানি না। তুমি যাহা জান না, তাহা আমিও জানি না। কেবল আমার অনুরোধ |”

নগেন্দ্র প্রত্যুত্তর করিলেন, “সূর্যমুখী, আমি মাতাল, মাতালকে শ্রদ্ধা হয়, আমাকে শ্রদ্ধা করিও। নচেৎ আবশ্যক করে না |”

সূর্যমুখী ঘরের বাহিরে গেলেন। ভৃত্যের প্রহার পর্যন্ত নগেন্দ্রের সম্মুখে আর চক্ষের জল ফেলিবেন না, প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন।

দেওয়ানজী বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “মা ঠাকুরাণীকে বলিও–বিষয় গেল, আর থাকে না |”

“কেন?”

“বাবু কিছু দেখেন না। সদর মফস্বলের আমলারা যাহা ইচ্ছা তাহা করিতেছে। কর্তার অমনোযোগে আমাকে কেহ মানে না |” শুনিয়া সূর্যমুখী বলিলেন, “যাঁহার বিষয়, তিনি রাখেন, থাকিবে। না হয়, গেল গেলই |”

ইতিপূর্বে নগেন্দ্র সকলই স্বয়ং তত্ত্বাবধান করিতেন।

একদিন তিন চারি হাজার প্রজা নগেন্দ্রের কাছারির দরওয়াজায় জোড়হাত করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। “দোহাই হুজুর–নায়েব গোমস্তার দৌরাত্ম্যে আর বাঁচি না। সর্বস্ব কাড়িয়া লইল। আপনি না রাখিলে কে রাখে?”

নগেন্দ্র হুকুম দিলেন, “সব হাঁকায় দাও |”

ইতিপূর্বেই তাঁহার একজন গোমস্তা একজন প্রজাকে মারিয়া একটা টাকা লইয়াছিল। নগেন্দ্র গোমস্তার বেতন হইতে দশটি টাকা লইয়া প্রজাকে দিয়াছিলেন।

হরদেব ঘোষাল নগেন্দ্রকে লিখিলেন, “তোমার কি হইয়াছে? তুমি কি করিতেছ? আমি কিছু ভাবিয়া পাই না। তোমার পত্র ত পাইই না। যদি পাই, ত সে ছত্র দুই, তাহার মানে মাথা মুণ্ড, কিছুই নাই। তাতে কোন কথাই থাকে না। তুমি কি আমার উপর রাগ করিয়াছ? ত বল না কেন? মোকদ্দমা হারিয়াছ? তাই বা বল না কেন? আর কিছু বল না বল, শারীরিক ভাল আছ কি না বল |”

নগেন্দ্র উত্তর লিখিলেন, “আমার উপর রাগ করিও না–আমি অধ:পাতে যাইতেছি|”

হরদেব বড় বিজ্ঞ। পত্র পড়িয়া মনে করিলেন, “কি এ? অর্থচিন্তা? বন্ধুবিচ্ছেদ? দেবেন্দ্র দত্ত? না, এ প্রেম?”

কমলমণি সূর্যমুখীর আর একখানি পত্র পাইলেন। তাহার শেষ এই “একবার এসো! কমলমণি! ভগিনি! তুমি বই আর আমার সুহৃদ কেহ নাই। একবার এসো!”