ইন্দিরা
কামিনী বলিল, “কুমুদিনী কি কে, তাহা বলিতে পারি না, একটা স্ত্রীলোক পরশু দিন পাল্কী করিয়া আসিয়াছিল বটে। সে বরাবর মহাভৈরবীর মন্দিরে গিয়া উঠিয়া দেবীকে প্রণাম করিল। অমনিই একটা আশ্চর্য ব্যাপার উপস্থিত হইল। হঠাৎ মেঘ অন্ধকার হইয়া ঝড়বৃষ্টি হইল। সেই স্ত্রীলোকটা সেইসময় ত্রিশূল হাতে করিয়া জ্বলিতে জ্বলিতে আকাশে উঠিয়া কোথায় চলিয়া গেল।”
প্রাণনাথ জলযোগ ত্যাগ করিলেন। হাত ধুইয়া মাথায় হাত দিয়া অনেক্ষণ বসিয়া রহিলেন; অনেকক্ষণ পরে বলিলেন, “যে স্থান হইতে কুমুদিনী অন্তর্ধান করিয়াছে, তাহা দেখিতে পাই না?”
কামিনী বলিল, “পাও বৈ কি? অন্ধকার হয়েছে—আলো নিয়ে আসি।”
এই বলিয়া কামিনী আমাকে ইঙ্গিত করিয়া গেল—“আগে তুই যা। তার পর আলো নিয়ে উপেন্দ্র বাবুকে লইয়া যাইব।” আমি আগে মন্দিরে গিয়া বারেণ্ডায় বসিয়া রহিলাম।
সেইখানে আলো ধরিয়া (খিড়কী দিয়া পথ আছে বলিয়াছি) কামিনী আমার স্বামীকে আমার কাছে লইয়া আসিল। তিনি আসিয়া আমার পদপ্রান্তে আছাড়িয়া পড়িলেন। ডাকিলেন, “কুমুদিনী, কুমুদিনী! যদি আসিয়াছ—ত আর আমায় ত্যাগ করিও না।”
তিনি বার দুই চারি এই কথা বলার পর, কামিনী চটিয়া উঠিয়া বলিল, “আয় দিদি! উঠে আয়! ও মিন্াসে কুমুদিনী চেনে, তোকে চেনে না।”
তিনি ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি! দিদি কে?”
কামিনী রাগ করিয়া বলিল, “আমার দিদি—ইন্দিরে। কখনও নাম শোন নি?”
এই বলিয়া দুষ্টা কামিনী আলোটা নিবাইয়া দিয়া আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিল। আমরা খুব ছুটিয়া আসিলাম। তিনি একটু প্রকৃতিস্থ হইলেই আমাদের পিছু পিছু ছুটিলেন। কিন্তু অন্ধকার—পথ অচেনা; একটা চৌকাট বাধিয়া একটা ছোট রকম আছাড় খাইলেন। আমরা নিকটেই ছিলাম, দুই জনে দুই দিক হইতে হাত ধরিয়া তুলিলাম। কামিনী চুপি চুপি বলিল, “আমরা বিদ্যাধরী—তোমার রক্ষার জন্য সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতেছি।”
এই বলিয়া, তাঁকে টানিয়া আনিয়া আমার শয্যাগৃহে উপস্থিত করিলাম। সেখানে আলো ছিল। তিনি আমাদের দেখিয়া বলিলেন, “এ কি? এ ত কামিনী, আর এ ত কুমুদিনী।” কামিনী রাগে দশখানা হইয়া বলিল, “আ: পোড়া কপাল! এই বুদ্ধিতে টাকা রোজগার করেছ? কোদাল পাড় নাকি? এ কুমুদিনী না,-ইন্দিরে-ইন্দিরে-ইন্দিরে!!! তোমার পরিবার! আপনার পরিবার চিনিতে পার না?”
তখন স্বামী মহাশয় আহ্লাদে অজ্ঞান হইয়া আমাকে কোলে টানিয়া লইতে গিয়া কামিনীকেই কোলে টানিয়া লইলেন। সে তাঁর গালে চড় মারিয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল।
সেদিনের আহ্লাদের কথা বলিয়া উঠিতে পারি না। বাড়ীতে খুব উৎসাহ বাধিল। সেই রাত্রে কামিনীতে আর উ-বাবুতে প্রায় এক শত বার বাগ্উযুদ্ধ হইল। সকলবারই প্রাণনাথ হারিলেন।