অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : ভারি জুয়াচুরির বন্দোবস্ত

সেদিন, দিবারাত্রি, আমার স্বামী, অন্যমনে ভাবিতে লাগিলেন। আমার সঙ্গে কথাবার্তা কহিলেন না—আমাকে দেখিলেই আমার মুখ পানে চাহিয়া থাকিতেন। তাঁহার অপেক্ষা আমার চিন্তার বিষয় বেশী; কিন্তু তাঁকে চিন্তিত দেখিয়া, আমার প্রাণের ভিতর বড় যন্ত্রণা হইতে লাগিল। আমি আপনার দু:খ চাপিয়া রাখিয়া, তাঁহাকে প্রফুল্ল করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। নানা প্রকার গঠনের ফুলের মালা, ফুলের তোড়া, ফুলের জিনিসপত্র গড়িয়া উপহার দিলাম, পানগুলা নানা রকমের সাজিলাম, নানা রকমের সুখাদ্য প্রস্তুত করিলাম, আপনি কাঁদিতেছি, তবু নানারসের রসভরা গল্পের অবতারণা করিলাম। আমার স্বামী বিষয়ী লোক—সর্বাপেক্ষা বিষয়কর্ম ভালবাসেন; তাহা বিচার করিয়া বিষয়কর্মের কথা পাড়িলাম; আমি হরমোহন দত্তের কন্যা, বিষয়কর্ম না বুঝিতাম, এমন নহে। কিছুতেই কিছু হইল না। আমার কান্নার উপর আরও কান্না বাড়িল।

পরদিন প্রাতে, স্নানাহ্নিকের পর জলযোগ করিয়া, তিনি আমাকে নিকটে বসাইয়া বলিলেন, “বোধ করি, যা জিজ্ঞাসা করিব, সকল কথার প্রকৃত উত্তর দিবে?”

তখন রমণ বাবুকে জেরা করার কথাটা মনে পড়িল। বলিলাম, “যাহা বলিব, সত্য বলিব। কিন্তু সকল কথার উত্তর না দিতে পারি।”

তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার স্বামী জীবিত আছেন, শুনিলাম। তাঁর নামধাম প্রকাশ করিবে?”

আমি। এখন না। দিন কত যাক।

তিনি। তিনি এখন কোথায় আছেন বলিবে?

আমি। এই কলিকাতায়।

তিনি। (একটু চমকিত হইয়া) তুমি কলিকাতায়, তোমার স্বামী কলিকাতায়, তবে তুমি তাঁর কাছে থাক না কেন?

আমি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নাই।

পাঠক দেখিও, আমি সব সত্য বলিতেছি। আমার স্বামী এই উত্তর শুনিয়া বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “স্ত্রী পুরুষে পরিচয় নাই? এ ত বড় আশ্চর্য কথা!”

আমি। সকলের কি থাকে? তোমার কি আছে?

একটু অপ্রতিভ হইয়া তিনি বলিলেন, “সে ত কতকগুলা দুর্দৈবে ঘটিয়াছে।”

আমি। দুর্দৈব সর্বত্র আছে।

তিনি। যাক—তিনি ভবিষ্যতে তোমার উপর কোন দাবিদাওয়া করিবার সম্ভাবনা আছে কি?

আমি। সে আমার হাত। আমি যদি তাঁর কাছে আত্মপরিচয় দিই, তবে কি হয় বলা যায় না।

তিনি। তবে তোমাকে সকল কথা ভাঙ্গিয়া বলি, তুমি খুব বুদ্ধিমতী, তাহা বুঝিয়াছি। তুমি কি পরামর্শ দাও শুনি।

আমি। বল দেখি।

তিনি। আমাকে বাড়ী যাইতে হইবে।

আমি। বুঝিলাম।

তিনি। বাড়ী গেলে শীঘ্র ফিরিতে পারিব না।

আমি। তাও শুনিতেছি।