তিনি বলিলেন, “তোমার ধর্ম তুমি জান। আমায় এমন দশায় ফেলিয়াছ যে, আমার আর ধর্মাধর্ম জ্ঞান নাই। আমি শপথ করিতেছি, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়েশ্বরী হইয়া থাকিবে। এক দিনের জন্য মনে করিও না।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “পুরুষের শপথে বিশ্বাস নাই। এক মুহূর্তের সাক্ষাতে কি এত হয়?” এই বলিয়া আবার চলিলাম—দ্বার পর্যন্ত আসিলাম। তখন আর ধৈর্যাবলম্বন করিতে না পারিয়া তিনি দুই হস্তে আমার দুই চরণ ধরিয়া পথরোধ করিলেন। বলিলেন, “আমি যে এমন আর কখন দেখি নাই।” তাহার মর্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। তাঁহার দশা দেখিয়া আমার দু:খও হইল। বলিলাম, “তবে তোমার বাসায় চল—এখানে থাকিলে তুমি আমার ত্যাগ করিয়া যাইবে।”

তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। তাঁহার বাসা সিমলায়, অল্প দূর। তাঁর গাড়িও হাজির ছিল, এবং দ্বারবানেরা নিদ্রিত। আমরা নি:শব্দে দ্বার খুলিয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। তাঁর বাসায় গিয়া দেখিলাম, দুই মহল বাড়ী। একটি ঘরে আমি অগ্রে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিলাম। স্বামী বাহিরে পড়িয়া রহিলেন। তিনি বাহির হইতে কাতরোক্তি করিতে লাগিলেন। ‍ আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “আমি এখন তোমারই দাসী হইলাম। কিন্তু দেখি, তোমার প্রণয়ের বেগ কাল প্রাত:কাল পর্যন্ত থাকে না থাকে। যদি কালও এমনি ভালবাসা দেখিতে পাই, তখন তোমার সঙ্গে আবার আলাপ করিব। আজ এই পর্যন্ত।”

আমি দ্বার খুলিলাম না; অগত্যা তিনি অন্যত্র গিয়া বিশ্রাম করিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের অসহ্য সন্তাপে, দারুণ তৃষাপীড়িত রোগীকে স্বচ্ছ শীতল জলাশয়তীরে বসাইয়া দিয়া, মুখ বাঁধিয়া দাও, যেন সে জল পান করিতে না পারে—বল দেখি, তার জলে ভালবাসা বাড়িবে কি না?

অনেক বেলা হইলে দ্বার খুলিলাম, দেখিলাম, স্বামী দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমি আপনার করে তাঁহার কর গ্রহণ করিয়া বলিলাম, “প্রাণনাথ, হয় আমাকে রামরাম দত্তের বাড়ী পাঠাইয়া দাও, নচেৎ অষ্টাহ আমার সঙ্গে আলাপ করিও না। এই অষ্টাহ তোমার পরীক্ষা।” তিনি অষ্টাহ পরীক্ষা স্বীকার করিলেন।