ইন্দিরা
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : আমার প্রাণত্যাগের প্রতিজ্ঞা
আমি হারাণীকে সতর্ক করিয়া দিয়া আপনার শয়নগৃহে গেলাম। বাবুদের আহারাদি হইয়া গিয়াছে। এমন সময়ে একটা বড় গণ্ডগোল পড়িয়া গেল। কেহ ডাকে পাখা, কেহ ডাকে জল, কেহ ডাকে ঔষধ, কেহ ডাকে ডাক্তার। এইরূপ হুলস্থূল। হারাণী হাসিতে হাসিতে আসিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত গণ্ডগোল কিসের?”
হা। সেই বাবুটি মূর্চ্ছা গিয়াছিলেন।
আমি। তার পর?
হা। এখন সামলেছেন।
আমি। তার পর?
হা। এখন বড় অবসন্ন—বাসায় যাইতে পারিলেন না। এখানেই বড় বৈঠকখানায় পাশের ঘরে শুইলেন।
বুঝিলাম, এ কৌশল। বলিলাম। “আলো সব নিবিলে, সবাই শুইলে আসিবে।”
হারাণী বলিল, “অসুখ যে গা।”
আমি বলিলাম, “অসুখ না তোর মুণ্ড। আর পাঁচ-শ খানা বিবির মুণ্ড, যদি দিন পাই।”
হারাণী হাসিতে হাসিতে গেল। পরে আলো সব নিবিলে, সবাই শুইলে, হারাণী আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া ঘর দেখাইয়া দিয়া আসিল। আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তিনি একাই শয়ন করিয়া আছেন। অবসন্ন কিছুই না; ঘরে দুইটা বড় বড় আলো জ্বলিতেছে, তিনি নিজের রূপরাশিতে সমস্ত আলো করিয়া আছেন। আমিও শরবিদ্ধ; আনন্দে শরীর আপ্লুত হইল।
যৌবন প্রাপ্তির পর আমার এই প্রথম স্বামিসম্ভাষণ। সে যে কি সুখ, তাহা কেমন করিয়া বলিব? আমি অত্যন্ত মুখরা—কিন্তু যখন প্রথম তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে গেলাম, কিছুতেই কথা ফুটিল না। কণ্ঠরোধ হইয়া আসিতে লাগিল। সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। হৃদয়মধ্যে দুপ দুপ শব্দ হইতে লাগিল। রসনা শুকাইতে লাগিল। কথা আসিল না বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিলাম।
সে অশ্রুজল তিনি বুঝিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, “কাঁদিলে কেন? আমি ত তোমাকে ডাকি নাই—তুমি আপনি আসিয়াছ—তবে কাঁদ কেন?”
এই নিদারুণ বাক্যে বড় মর্মপীড়া হইল। তিনি যে আমাকে কুলটা মনে করিতেছেন—ইহাতে চক্ষুর প্রবাহ আরও বাড়িল। মনে করিলাম, এখন পরিচয় দিই—এ যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না, কিন্তু তখনই মনে হইল যে, পরিচয় দিলে যদি ইনি না বিশ্বাস করেন, যদি মনে করেন যে, “ইহার বাড়ী কালাদীঘি, অবশ্য আমার স্ত্রীহরণের বৃত্তান্ত শুনিয়াছে, এক্ষণে ঐশ্বর্যলোভে আমার স্ত্রী বলিয়া মিথ্যা পরিচয় দিতেছে”—তাহা হইলে কি প্রকারে ইঁহার বিশ্বাস জন্মাইব? সুতরাং পরিচয় দিলাম না। দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া, চক্ষুর জল মুছিয়া, তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলাম। অন্যান্য কথার পরে তিনি বলিলেন, “কালাদীঘি তোমার বাড়ী শুনিয়া আমি আশ্চর্য হইয়াছি। কালদীঘিতে যে এমন সুন্দরী জন্মিয়াছে, তাহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না।”