শ্যামাসুন্দরী ভাতৃজায়াকে কখনও “বউ”, কখনও আদর করিয়া “বন”, কখনো “মৃণো” সম্বোধন করিতেছিলেন। কপালকুণ্ডলা নামটি বিকট বলিয়া, গৃহস্থেরা তাঁহার নাম মৃণ্ময়ী রাখিয়াছিলেন; এই জন্যই “মৃণো” সম্বোধন। আমরাও এখন কখন কখন ইঁহাকে মৃণ্ময়ী বলিব।

শ্যামাসুন্দরী একটি শৈশবাভ্যস্ত কবিতা বলিতেছিলেন, যথা –

“বলে–পদ্মরাণি, বদনখানি, রেতে রাখে ঢেকে।

     ফুটায় কলি, ছুটায় অলি, প্রাণপতিকে দেখে॥

আবার–মনের লতা, ছড়িয়ে পাতা, গাছের দিকে ধায়।

     নদীর জল, নামলে ঢল, সাগরেতে যায়॥

ছি ছি–সরম টুটে, কুমুদ, ফুটে, চাঁদের আলো পেলে।

     বিয়ের কনে রাখতে নারি ফুলশয্যা গেলে॥

মরি–এ কি জ্বালা, বিধির খেলা, হরিষে বিষাদ।

     পরপরশে, সবাই রসে, ভাঙ্গে লাজের বাঁধ ||”

“তুই কি লো একা তপস্বিনী থাকিবি?”

মৃণ্ময়ী উত্তর করিল, “কেন, কি তপস্যা করিতেছি?”

শ্যামাসুন্দরী দুই করে মৃণ্ময়ীর কেশতরঙ্গমালা তুলিয়া কহিল, “তোমার রাশি কি বাঁধিবে না?”

মৃণ্ময়ী কেবল ঈষৎ হাসিয়া শ্যামাসুন্দরীর হাত হইতে কেশগুলি টানিয়া লইলেন।

শ্যামাসুন্দরী আবার কহিলেন, “ভাল আমার সাধটি পুরাও। একবার আমাদের গৃহস্থের মেয়ের মত সাজ। কতদিন যোগিনী থাকিবে?”

মৃ। যখন এই ব্রাহ্মণসন্তানের সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই, তখন ত আমি যোগিনীই ছিলাম।

শ্যা। এখন থাকিতে পারিবে না।

মৃ। কেন থাকিব না?

শ্যা। কেন? দেখিবি? যোগ ভাঙ্গিব। পরশপাতর কাহাকে বলে জান?

মৃণ্ময়ী কহিলেন, “না |”

শ্যা। পরশপাতরের স্পর্শে রাঙ্গও সোনা হয়।

মৃ। তাতে কি

শ্যা। মেয়েমানুসেরও পরশপাতর আছে।

মৃ। সে কি?

শ্যা। পুরুষ। পুরুষের বাতাসে যোগিনীও গৃহিণী হইয়া যায়। তুই সেই পাতর ছুঁয়েছিস্। দেখিবি,

“বাঁধব চুলের রাশ,       পরাব চিকন বাস,

              খোঁপায় দোলাব তোর ফুল।

কপালে সীঁথির ধার,       কাঁকালেতে চন্দ্রহার,

              কানে তোর দিব যোড়া দুল॥

কুঙ্কুম চন্দন চুয়া,       বাটা ভরে পান গুয়া,

              রাঙ্গামুখ রাঙ্গা হবে রাগে।

সোণার পুত্তলি ছেলে,       কোলে তোর দিব ফেলে,

              দেখি ভাল লাগে কি না লাগে ||”