নবকুমার উঠিয়া বসিলেন। কহিলেন, “আমিও সেই আশঙ্কা করিতেছিলাম। আপনি সকল অবগত আছেন–ইহার উপায় করুন। আমার প্রাণদান করিলে যদি কোন প্রত্যুপকার হয়–তবে তাহাতেও প্রস্তুত আছি। আমি এমন সঙ্কল্প করিতেছি যে, আমি সেই নরঘাতকের নিকট প্রত্যাগমন করিয়া আত্নসমর্পন করি। তাহা হইলে ইহার রক্ষা হইবে |” অধিকারী হাস্য করিয়া কহিলেন, “তুমি বাতুল। ইহাতে কি ফল দর্শিবে? তোমারও প্রাণসংহার হইবে–অথচ ইহার প্রতি মহাপুরুষের ক্রোধোপশম হইবে না। ইহার একমাত্র উপায় আছে |”

নব। সে কি উপায়?

অধি। আপনার সহিত ইহার পলায়ন। কিন্তু সে অতি দুর্ঘ ট। আমার এখানে থাকিলে দুই এক দিনের মধ্য ধৃত হইবে। এ দেবালয়ে মহাপুরুষের সর্ব্বঅদা যাতায়াত। সুতরাং কপালকুণ্ডলার অদৃষ্টে অশুভ দেখিতেছি।

নবকুমার আগ্রহসহকারে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার সহিত পলায়ন দুর্ঘট কেন?”

অধি। এ কাহার কন্যা,-কোন্ কুলে জন্ম, তাহা আপনি কিছুই জানেন না। কাহার পত্নী,-কি চরিত্রা, তাহা কিছুই জানেন না! আপনি ইহাকে কি সঙ্গিনী করিবেন? সঙ্গিনী করিয়া লইয়া গেলেও আপনি ইহাকে নিজগৃহে স্থান দিবেন? আর যদি স্থান না দেন, তবে এ অনাথা কোথায় যাইবে?

নবকুমার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আমার প্রাণরক্ষয়িত্রীর জন্য কার্য আমার অসাধ্য নহে। ইনি আমার আত্মপরিবারস্থা হইয়া থাকিবেন |”

অধি। ভাল। কিন্তু যখন আপনার আত্মীয়-স্বজন জিজ্ঞাসা করিবে যে, এ কাহার স্ত্রী, কি উত্তর দিবেন?

নবকুমার পুনর্বার চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আপনিই ইহার পরিচয় আমাকে দিন। আমি সেই পরিচয় সকলকে দিব |”

অধি। ভাল। কিন্তু পক্ষান্তরের পথ যুবক যুবতী অনন্যসহায় হইয়া কি প্রকারে যাইবে? লোকে দেখিয়া শুনিয়া কি বলিবে? আত্মীয়-স্বজনের নিকট কি বুঝাইবে? আর আমিও এই কন্যাকে মা বলিয়াছি, আমিই বা কি প্রকারে অজ্ঞাতচরিত্র যুবার সহিত একাকী দূরদেশে পাঠাইয়া দিই?

ঘটকরাজ ঘটকালিতে মন্দ নহেন।

নবকুমার কহিলেন, “আপনি সঙ্গে আসুন |”

অধি। আমি সঙ্গে যাইব? ভবানীর পূজা কে করিবে?

নবকুমার ক্ষুব্ধ হইয়া কহিলেন, “তবে কি কোন উপায় করিতে পারেন না?”

অধি। একমাত্র উপায় হইতে পারে,-সে আপনার ঔদার্য গুণের অপেক্ষা করে।

নব। সে কি? আমি কিসে অস্বীকৃত? কি উপায় বলুন?

অধি। শুনুন। ইনি ব্রাহ্মণকন্যা। ইঁহার বৃত্তান্ত আমি সবিশেষ অবগত আছি। ইনি বাল্যকালে দুরন্ত খ্রীষ্টিয়ান তস্কর কর্ত্তৃ্ক অপহৃত হইয়া যানভঙ্গপ্রযুক্ত

তাহাদিগের দ্বারা কালে এ সমুদ্রতীরে ত্যক্ত হয়েন। সে সকল বৃত্তান্ত পশ্চাৎ ইঁহার নিকট আপনি সবিশেষ অবগত হইতে পারিবেন। কাপালকি ইঁহাকে প্রাপ্ত হইয়া আপন যোগসিদ্ধিমানসে প্রতিপালন করিয়াছিলেন। অচিরাৎ আত্মপ্রয়োজন সিদ্ধ করিতেন। ইনি এ পর্যন্ত অনূঢ়া; ইঁহার চরিত্র পরম পবিত্র। আপনি ইঁহাকে বিবাহ করিয়া গৃহে চলিয়া যান। কেহ কোন কথা বলিতে পারিবে না। আমি যথাশাস্ত্র বিবাহ দিব।

নবকুমার শয্যা হইতে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। অতি দ্রুতপাদবিক্ষেপে ইতস্তত: ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। কোন উত্তর করিলেন না। অধিকারী কিয়ৎক্ষণ পরে কহিলেন,

“আপনি এক্ষণে নিদ্রা যান। কল্য প্রত্যূষে আপনাকে আমি জাগরিত করিব। ইচ্ছা হয়, একাকী যাইবেন। আপনাকে মেদিনীপুরের পথে রাখিয়া আসিব |”

এই বলিয়া অধিকারী বিদায় লইলেন। গমনকালে মনে মনে করিলেন, “রাঢ়দেশের ঘটকালি কি ভুলিয়া গিয়াছ না কি?”