কপালকুণ্ডলা
ক। কেন?
অ। গেলে তোমার রক্ষা নাই।
ক। তা ত জানি।
অ। তবে আর জিজ্ঞাসা কর কেন?
ক। না গিয়া কোথায় যাইব?
অ। এই পথিকের সঙ্গে দেশান্তরে যাও।
কপালকুণ্ডলা নীরব হইয়া রহিলেন। অধিকারী কহিলেন, “মা, কি ভাবিতেছ?”
ক। যখন তোমার শিষ্য আসিয়াছিল, তখন তুমি কহিয়াছিলে যে, যুবতীর
এরূপ যুবাপুরুষের সহিত যাওয়া অনুচিত; এখন যাইতে বল কেন?
অ। তখন তোমার জীবনের আশঙ্কা করি নাই, বিশেষ যে সদুপায়ের
সম্ভাবনা ছিল না, এখন সে সদুপায় হইতে পারিবে। আইস, মায়ের অনুমতি
লইয়া আসি।
এই বলিয়া অধিকারী দীপহস্তে দেবালয়ের দ্বারে গিয়া দ্বারোদ্ঘাটন করিলেন। কপালকুণ্ডলাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। মন্দিরমধ্যে মানবাকারপরিমিতা করাল কালীমূর্তি সংস্থাপিত ছিল। উভয়ে ভক্তিভাবে প্রণাম করিলেন। অধিকারী আচমন করিয়া পুষ্পপাত্র হইতে একটি অচ্ছিন্ন বিল্বপত্র লইয়া মন্ত্রপূত করিলেন, এবং তাহা প্রতিমার পাদোপরি সংস্থাপিত করিয়া তৎপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণেক পরে অধিকারী কপালকুণ্ডলাকে কহিলেন,
“মা দেখ, দেবী অর্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছেন; বিল্বপত্র পড়ে নাই, যে মানস করিয়া অর্ঘ্য দিয়াছিলাম, তাহাতে অবশ্য মঙ্গল। তুমি এই পথিকের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে গমন কর; কিন্তু আমি বিষয়ী লোকের রীতি চরিত্র জানি। তুমি যদি গলগ্রহ হইয়া ইহার সঙ্গে যাও, তবে এ ব্যক্তি অপরিচিত যুবতী সঙ্গে লইয়া লোকালয়ে লজ্জা পাইবে। তোমাকেও লোকে ঘৃণা করিবে। তুমি বলিতেছ, এ ব্যক্তি ব্রাহ্মণসন্তান; গলাতেও যজ্ঞোপবীত দেখিতেছি। এ যদি তোমাকে বিবাহ করিয়া লইয়া যায়, তবে সকল মঙ্গল। নচেৎ আমিও তোমাকে ইহার সহিত যাইতে বলিতে পারি না |”
“বি-বা-হ!” এই কথাটি কপালকুণ্ডলা অতি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করিলেন। বলিতে লাগিলেন, “বিবাহের নাম ত তোমাদিগের মুখে শুনিয়া থাকি, কিন্তু কাহাকে বলে সবিশেষ জানি না। কি করিতে হইবে?”
অধিকারী ঈষন্মাত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “বিবাহ স্ত্রীলোকের একমাত্র ধর্মের সোপান; এই জন্য স্ত্রীকে সহধর্মিনী বলে; জগন্মাতাও শিবের বিবাহিতা |”
অধিকারী মনে করিলেন, সকলই বুঝাইলেন। কপালকুণ্ডলা মনে করিলেন, সকলই বুঝিলেন। বলিলেন, “তাহাই হউক। কিন্তু তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া যাইতে আমার মন সরিতেছে না। তিনি যে আমাকে এতদিন প্রতিপালন করিয়াছেন |”
অধি। কি জন্য প্রতিপালন করিয়াছেন, তাহা জান না।
এই বলিয়া অধিকারী তান্ত্রিক সাধনে স্ত্রীলোকের যে সম্বন্ধ, তাহা অস্পষ্ট রকম কপালকুণ্ডলাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন। কপালকুণ্ডলা তাহা কিছু বুঝিল না, কিন্তু তাহার বড় ভয় হইল। বলিল, “তবে বিবাহই হউক |”
এই বলিয়া উভয়ে মন্দির হইতে বহির্গত হইলেন। এক কক্ষমধ্যে কপালকুণ্ডলাকে বসাইয়া, অধিকারী নবকুমারের শয্যাসন্নিধানে গিয়া তাহার শিওরে বসিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! নিদ্রিত কি?” নবকুমারের নিদ্রা যাইবার অবস্থা নহে; নিজ দশা ভাবিতেছিলেন। বলিলেন, “আজ্ঞে না |”