রাজসিংহ
অষ্টম পরিচ্ছেদ : অগ্নিনির্বাণের পরামর্শ
মহারাণার সাক্ষাৎ পাইয়া, প্রণাম করিয়া মাণিকলাল যুক্তকরে নিবেদন করিলেন, “যদি এ দাসকে অন্য কোন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান মহারাজের অভিপ্রায় হয়, তবে বড় অনুগৃহীত হইব |”
রাণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, এখানে কি হইয়াছে?”
মাণিকলাল উত্তর করিল, “এখানে ত কোন কাজ নাই। কাজের মধ্যে ক্ষুধার্ত মোগলদিগের শুষ্ক মুখ দেখা ও আর্তনাদ শুনা। তাহা কখনও কখনও পর্বতের উপর গাছে চড়িয়া দেখিয়া আসিতেছি। কিন্তু সে কাজ, যে সে পারিবে। আমি ভাবিতেছি কি যে, এতগুলা মানুষ, হাতী, ঘোড়া, উট, এই রন্ধ্রে পচিয়া মরিয়া থাকিবে,-দুর্গন্ধে উদয়পুরেও কেহ বাঁচিবে না–বড় মড়ক উপস্থিত হইবে |”
রাণা বলিলেন, “অতএব তোমার বিবেচনা এই, মোগল সেনাকে অনাহারে মারিয়া ফেলা অকর্তব?”
মাণিক। বোধ হয়। যুদ্ধে লক্ষ জনকে মারিলেও দেখিয়া দু:খ হয় না। বসিয়া বসিয়া অনাহারে একজন লোকও মরিলে দু:খ হয়।
রাণা। তবে উহাদিগের সম্বন্ধে কি করা যায়?
মাণিক। মহারাজ! আমার এত বুদ্ধি নাই যে, আমি এমন বিষয়ে পরামর্শ দিই। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে সন্ধিসংস্থাপনের এই উত্তম সময়। জঠরাগ্নির দাহের সময়ে মোগল যেমন নরম হইবে, ভরা পেটে তেমন হইবে না। আমার বোধ হয়, রাজমন্ত্রিগণ ও সেনাপতিগণকে ডাকিয়া পরামর্শ করিয়া এ বিষয়ের মীমাংসা করা ভাল।
রাজসিংহ এ প্রস্তাবে সম্মত ও স্বীকৃত হইলেন। উপবাসে এত মানুষ মারাও তাঁহার ইচ্ছা নহে। হিন্দু, ক্ষুধার্তের অন্ন যোগান পরমধর্ম বলিয়া জানে। অতএব হিন্দু, শত্রুকেও সহজে উপবাসে মারিতে চাহে না।
সন্ধ্যার পর শিবিরে রাজসভা সমবেত হইল। তথা প্রধান সেনাপতিগণ, প্রধান রাজমন্ত্রিগণ উপস্থিত হইলেন। রাজমন্ত্রিগণের মধ্যে প্রধান দয়াল সাহা। তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মাণিকলালও ছিল।
রাজসিংহ বিচার্য্ বিষয়টা সকলকে বুঝাইয়া দিয়া, সভাসদগণের মত জিজ্ঞাসা করিলেন। অনেকেই বলিলেন, “মোগল ঐখানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিয়া পচিয়া থাকুক–ঔরঙ্গজেব বেটাকে ধরিয়া আনিয়া উহাদের গোর দেওয়াইব। না হয়, দোসাদের দল আনিয়া মাটি চাপা দেওয়াইব। মোগল হইতে বার বার রাজপুতের যে অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা স্মরণ করিলে, কাহারও ইচ্ছা হইবে না যে, মোগলকে হাতে পাইয়া ছাড়া যায় |”
ইহার উত্তরে মহারাণা বলিলেন, “না হয় স্বীকার করিলাম যে, এই মোগলদিগকে এইখানে শুকাইয়া মারিয়া মাটি চাপা দেওয়া গেল। কিন্তু ঔরঙ্গজেব আর ঔরঙ্গজেবের উপস্থিত সৈন্যগণ মরিলেই মোগল নি:শেষ হইল না। ঔরঙ্গজেব মরিলে শাহ আলম বাদশাহ হইবে। শাহ আলমের সঙ্গে দাক্ষিণাত্য-বিজয়ী মহাসৈন্য পর্বতের অপর পারে সশস্ত্রে উপস্থিত আছে। আর দুইটা মোগলসেনা আর দুই দিকে বসিয়া আছে। আমরা কি এই সকলগুলিকে নি:শেষ ধ্বংস করিতে পারিব? যদি না পারি, তবে অবশ্য একদিন সন্ধিস্থাপন করিতে হইবে। যদি সন্ধি করিতে হয়, তবে এমন সুসময় আর কবে হইবে? এখন ঔরঙ্গজেবের প্রাণ কণ্ঠাগত–এখন তাহার কাছে যাহা চাহিব, তাহা পাইব। সময়ান্তরে কি তেমন পাইব?”
দয়াল সাহা বলিলেন, “নাই পাইলাম। তবু এই মহাপাপিষ্ঠ পৃথিবীর কণ্টকস্বরূপ ঔরঙ্গজেবকে বধ করিলে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করা হইবে। এমন পুণ্য আর কোন কার্যে নাই, মহারাজ মতান্তর করিবেন না |”