রাজসিংহ বলিলেন, “সকল মোগল বাদশাহই দেখিলাম–পৃথিবীর কণ্টক। ঔরঙ্গজেব শাহজাঁহার অপেক্ষাও কি নরাধম? খস্রু হইতে আমাদের যত অমঙ্গল ঘটিয়াছে, ঔরঙ্গজেব হইতে কি তত হইয়াছে? শাহ আলম যে পিতৃপিতামহ হইতেও দুরাচার না হইবে, তাহার স্থিরতা কি? আর তোমরা যদি এমন ভরসাই কর–সে ভরসা আমিও না করি, তা নয়–যে এই চারিটি মোগল সেনাই আমরা পরাজিত করিতে পারিব, তবে ভাবিয়া দেখ, কত অসংখ্য মনুষ্যহত্যার পর সে আশা ফলে পরিণত হইবে। কত অসংখ্য রাজপুত বিনষ্ট হইবে। অবশিষ্ট থাকিবে কয় জন? আমরা অল্পসংখ্যক; মুসলমান বহুসংখ্যক। আমরা সংখ্যায় কমিয়া গেলে, আবার যদি মোগল আসে, তবে কার বাহুবলে তাদের আবার তাড়াইব?”

দয়াল সাহা বলিল, “মহারাজ! সমস্ত রাজপুতানা একত্রিত হইলে মোগলকে সিন্ধু পার করিয়া রাখিয়া আসিতে কতক্ষণ লাগে?”

রাজসিংহ বলিলেন, “সে কথা সত্য। কিন্তু তাহা কখন হইয়াছে কি? এখনও ত সে চেষ্টা করিতেছি–ঘটিতেছে কি? তবে সে ভরসা কি প্রকারে করিব?”

দয়াল সাহা বলিলেন, “সন্ধি হইলেও ঔরঙ্গজেব সন্ধি রক্ষা করিবে, এমন ভরসা করি না। অমন মিথ্যাবাদী, ভণ্ড কখনও জন্মগ্রহণ করে নাই। মুক্তি পাইলেই, সে সন্ধিপত্র ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, যা করিতেছিল, তাহাই করিবে |”

রাজসিংহ বলিলেন, “তাহা ভাবিলে কখনই সন্ধি করা হয় না। তাই কি মত?”

এইরূপ অনেক বিচার হইল। পরিশেষে সকলেই রাণার কথার যথার্থ্য স্বীকার করিলেন।

সন্ধিস্থাপনের কথাই স্থির হইল।

তখন কেহ আপত্তি করিল, “ঔরঙ্গজেব ত কই, সন্ধির চেষ্টায় দূত পাঠান নাই। তাঁর গরজ, না আমাদের গরজ?”

তাহাতে রাজসিংহ উত্তর করিলেন, “দূত আসিবে কি প্রকারে? সে রন্ধ্রপথের ভিতর হইতে একটি পিঁপ‍ড়া উপরে আসিবার পথ রাখি নাই |”

দয়াল সাহা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে আমাদেরই বা দূত যাইবে কি প্রকারে? সেবার ঔরঙ্গজেব আমাদিগের দূতকে বধ করিবার আজ্ঞা দিয়াছিল, এবার যে সে আজ্ঞা দিবে না, তার ঠিকানা কি?”

রাজসিংহ বলিলেন, “এবার যে বধ করিবে না, তাহা স্থির। কেন না, এখন কপট সন্ধিতেও তাহার মঙ্গল। তবে দূত যেখানে যাইবে কি প্রকারে, তাহার গোলযোগ আছে বটে |”

তখন মাণিকলাল নিবেদন করিল, “সে ভার আমার উপর অর্‍পিত হউক। আমি মহারাণার পত্র ঔরঙ্গজেবের নিকট পৌঁছাইয়া দিব, এবং উত্তর আনিয়া দিব |”

সকলেই সে কথায় বিশ্বাস করিল; কেন না, সকলেই জানিত, কৌশলে ও সাহসে মাণিকলাল অদ্বিতীয়। অতএব পত্র লিখিবার হুকুম হইল। দয়াল সাহা পত্র প্রস্তুত করাইলেন। তাহার মর্‍ম এই যে–বাদশাহ, সমস্ত সৈন্য মেবার হইতে উঠাইয়া লইয়া যাইবেন। মেবারে গোহত্যা ও দেবালয়ভঙ্গ নিবারণ করিবেন, এবং জেজেয়ার কোন দাবি করিবেন না। তাহা হইলে রাজসিংহ পথ মুক্ত করিয়া দিবেন, নিরুদ্বেগে বাদশাহকে যাইতে দিবেন।

পত্র সভাসদ সকলকে শুনান হইল। শুনিয়া মাণিকলাল বলিল, “বাদশাহের স্ত্রী-কন্যা আমাদিগের নিকট বন্দী আছে। তাহারা থাকিবে?”

বলিবামাত্র সভামধ্যে একটা হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। সকলে একবাক্যে বলিল, “ছাড়া হইবে না |” কেহ বলিল, “থাক। উহারা মহারাণার আঙ্গিনা ঝাঁটাইবে |” কেহ বলিল, “উহাদের ঢাকায় পাঠাইয়া দাও। হিন্দু হইয়া, বৈষ্ণবী সাজিয়া, হরিনাম করিবে |” কেহ বলিল, “উহাদের মূল্যস্বরূপ এক এক ক্রোর টাকা বাদশাহ দিবেন |” ইত্যাদি নানা প্রকার প্রস্তাব হইল। মহারাণা বলিলেন, “দুইটা মুসলমান বাঁদীর জন্য সন্ধি ত্যাগ করা হইবে না। সে দুইটাকে ফিরাইয়া দিব, লিখিয়া দাও |”

সেইরূপ লেখা হইল। পত্রখানি মাণিকলালের জিম্মা হইল। তখন সভাভঙ্গ হইল।