ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : শাহজাদী ভস্ম হইল

অর্দ্ধ রাত্রি অতীত; সকলে নি:শব্দে নিদ্রিত। জেব-উন্নিসা বাদশাহ-দুহিতা সুখশয্যায় অশ্রুমোচনে বিবশা, কদাচিৎ দাবাগ্নিপরিবেষ্টিত ব্যাঘ্রীর মত কোপতীব্রা। কিন্তু তখনই যেন বা শরবিদ্ধা হরিণীর মত কাতরা। রাত্রিটা ভাল নহে; মধ্যে মধ্যে গভীর হুঙ্কারের সহিত প্রবল বায়ু বহিতেছে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, বাতায়নপথলক্ষ্য গিরিশিখরমালায় প্রগাঢ় অন্ধকার–কেবল যথায় রাজপুতের শিবির, তথায় বসন্তকাননে কুসুমরাজি তুল্য, সমুদ্রে ফেননিচয় তুল্য, এবং কামিনীকমনীয় দেহে রত্নরাশি তুল্য, এক স্থানে বহুসংখ্যক দীপ জ্বলিতেছে–আর সর্‍বত্র নি:শব্দ, প্রগাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন, কদাচিৎ সিপাহীর হস্তমুক্ত বন্দুকের প্রতিধ্বনিতে ভীষণ। কখনও বা মেঘের “অদ্রিগ্রহণগুরুগর্‍জিত,”–কখন বা একমাত্র কামানের, শৃঙ্গে শৃঙ্গে প্রতিধ্বনিত তুমুল কোলাহল। রাজপুরীর অশ্বশালায় ভীত অশ্বের হ্রেষা; রাজপুরীর উদ্যানে ভীত হরিণীর কাতরোক্তি। সেই ভয়ঙ্করী নিশীথিনীর সকল শব্দ শুনিতে শুনিতে বিষণ্ণমনে জেব-উন্নিসা ভাবিতেছিল, “ঐ যে কামান ডাকিল, বোধ হয় মোগলের কামান–নহিলে কামান অমন ডাকিতে জানে না। আমার পিতার তোপ ডাকিল–এমন শত শত তোপ আমার বাপের আছে–একটাও কি আমার হৃদয়ের জন্য নহে? কি করিলে এই তোপের মুখে বুক পাতিয়া দিয়া, তোপে আগুনে সকল জ্বালা জুড়াই? কাল সৈন্যমধ্যে গজপৃষ্ঠে চড়িয়া লক্ষ সৈন্যের শ্রেণী দেখিয়াছিলাম, লক্ষ অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা শুনিয়াছিলাম–তার একখানিতে আমার সব জ্বালা ফুরাইতে পারে; কৈ, সে চেষ্টা ত করি নাই? হাতীর উপর হইতে লাফাইয়া পড়িয়া, হাতীর পায়ের তলে পিষিয়া মরিতে পারিতাম–কৈ? সে চেষ্টাও ত করি নাই। কেন করি নাই? মরিবার ইচ্ছা আছে, কিন্তু মরিবার উদ্যোগ করি নাই কেন? এখনও ত সঙ্গে অনেক হীরা আছে, গুঁড়াইয়া খাইয়া মরি না কেন? আমার মনের আর সে শক্তি নাই যে, উদ্যোগ করিয়া মরি |”

এমন সময়ে বেগবান বায়ু, মুক্তদ্বার কক্ষমধ্যে, অতি বেগে প্রবেশ করিয়া সমস্ত বাতি নিবাইয়া দিল। অন্ধকারে জেব-উন্নিসার মনে একটু ভয়ের সঞ্চার হইল। জেব-উন্নিসা ভাবিতে লাগিল, “ভয় কেন? এই ত মরণ কামনা করিতেছিলাম! যে মরিতে চাহে, তার আবার কিসের ভয়? ভয়? কাল মরা মানুষ দেখিয়াছি, আজও বাঁচিয়া আছি। বুঝি যেখানে মরা মানুষ থাকে, সেইখানে যাইব ইহা নিশ্চিত; তবে ভয় কিসের? তবে বেহেস্ত আমার কপালে নাই–বুঝি জাহান্নায় যাইতে হইবে, তাই এত ভয়! তা, এত দিন এ সকল কথা কিছুই বিশ্বাস করি নাই। জাহান্নাও মানি নাই, বেহেস্তও মানি নাই; খোদাও জানিতাম না, দীন‍ও জানিতাম না। কেবল ভোগবিলাসই জানিতাম। আল্লা রহিম! তুমি কেন ঐশ্বর্য্য দিয়াছিলে? ঐশ্বর্‍যই আমার জীবন বিষময় হইল। তোমায় আমি তাই চিনিলাম না। ঐশ্বর্‍য সুখ নাই, তাহা আমি জানিতাম না, কিন্তু তুমি ত জান! জানিয়া শুনিয়া নির্‍দয় হইয়া কেন এ দু:খ দিলে? আমার মত ঐশ্বর্য্য কাহার কপালে ঘটিয়াছে? আমার মত দু:খী কে?”

শয্যায় পিপীলিকা, কি অন্য একটা কীট ছিল–রত্নশয্যাতেও কীটের সমাগমের নিষেধ নাই–কীট জেব-উন্নিসাকে দংশন করিল। যে কোমলাঙ্গে পুষ্পধন্বাও শরাঘাতের সময়ে মৃদুহস্তে বাণক্ষেপ করেন, তাহাতে কীট অবলীলাক্রমে দংশন করিয়া রক্ত বাহির করিল। জেব-উন্নিসা জ্বালায় একটু কাতর হইল। তখন জেব-উন্নিসা মনে মনে একটু হাসিল। ভাবিল “পিপীলিকার দংশনে আমি কাতর! এই অনন্ত দু:খের সময়েও কাতর! আপনি পিপীলিকাদংশন সহ্য করিতে পারিতেছি না, আর অবলীলাক্রমে আমি, যে আমার প্রাণাধিক প্রিয়, তাহাকে ভুজঙ্গমদংশনে প্রেরণ করিলাম। এমন কেহ নাই যে, আমাকে তেমনই বিষধর সাপ আনিয়া দেয়! হয় সাপ, নয় মবারক!”