পঞ্চম পরিচ্ছেদ : অগ্নিতে ইন্ধনক্ষেপ–জ্বালা বাড়িল

পরদিন যখন জেব-উন্নিসা শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিলেন, তখন আর তাঁহাকে চেনা যায় না। একে ত পূর্‍বেই মূর্‍তি শীর্‍ণা বিবর্‍ণা কাদম্বিনীচ্ছায়াপ্রচ্ছন্নাবৎ হইয়াছিল–আজ আরও যেন কি হইয়াছে, বোধ হইতে লাগিল। সমস্ত দিনরাত্র আগুনের তাপের নিকট বসিয়া থাকিলে মানুষ যেমন হয়, চিতারোহণ করিয়া, না পুড়িয়া কেবল ধূম ও তাপে অর্ধদগ্ধা হইয়া চিতা হইতে নামিলে যেমন হয়, জেব-উন্নিসাকে আজ তেমনই দেখাইতেছিল। জেব-উন্নিসা মুহূর্‍তে মুহূর্‍তে পুড়িতেছিল।

বেশভূষা না করিলে নয়; জেব-উন্নিসা অত্যন্ত অনিচ্ছায় বেশভূষা করিয়া, নিয়ম ও অনুরোধ রক্ষার্‍থ জলযোগ করিল। তার পর প্রথমে উদিপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গেল। দেখিল, উদিপুরী একা বসিয়া আছে–সম্মুখে কুমারী মেরীর প্রতিমূর্‍তি এবং একটি যিশূর ক্রস্। অনেক দিন উদিপুরী যিশুকে এবং তাঁহার মাতাকে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। আজ দুর্দ্দিনে তাঁহাদের মনে পড়িয়াছিল। খ্রিষ্টিয়ানির চিহ্নস্বরূপ এই দুইটি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত; বৃষ্টির দিনে দু:খীর পুরাণ ছাতির মত আজ তাহা বাহির হইয়াছিল। জেব-উন্নিসা দেখিলেন, উদিপুরীর চক্ষে অবিরল অশ্রুধারা ঝরিতেছে; বিন্দুর পশ্চাৎ বিন্দু, বিন্দুর পশ্চাৎ বিন্দু, নি:শব্দে দুগ্ধালক্তকনিন্দী গণ্ড বাহিয়া ঝরিতেছে। জেব-উন্নিসা উদিপুরীকে এত সুন্দর কখনও দেখেন নাই। সে স্বভাবত: পরম সুন্দরী–কিন্তু গর্‍বে, ভোগবিলাসে, ঈর্ষাদির জ্বালায়, সর্‍বদাই সে অতুল সৌন্দর্‍য একটু বিকৃত হইযা থাকিত। আজ অশ্রুস্রোতে সে বিকৃতি ধুইয়া গিয়াছিল–অপূর্‍ব রূপরাশির পূর্ণ বিকাশ হইয়াছিল।

উদিপুরী জেব-উন্নিসাকে দেখিয়া আপনার দু:খের কথা বলিতেছিলেন। বলিলেন, “আমি বাঁদী ছিলাম–বাঁদীর দরে বিক্রীত হইয়াছিলাম –কেন বাঁদীই রহিলাম না! কেন আমার কপালে ঐশ্বর্‍য্ ঘটিয়াছিল!___”

এই পর্‍যন্ত বলিয়া উদিপুরী, জেব-উন্নিসার মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, “তোমার অবস্থা এমন কেন? তোমার কি হইয়াছিল? কাফের তোমার উপরও কি অত্যাচার করিয়াছে?”

জেব-উন্নিসা দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “কাফেরের সাধ্য কি? আল্লা করিয়াছেন |”

উ। সকলই তিনি করেন, কিন্তু কি ঘটিয়াছে, শুনিতে পাই না?

জে। এখন সে কথা মুখে আনিতে পারিব না। মৃত্যুকালে বলিয়া যাইব।

উ। যাই হৌক, ঈশ্বর যেন রাজপুতের এ স্পর্‍ধার দণ্ড করেন।

জে। রাজপুতের ইহাতে কোন দোষ নাই।

এই কথা বলিয়া জেব-উন্নিসা নীরব হইয়া রহিল। উদিপুরীও কিছু বলিল না। পরিশেষে চঞ্চলকুমারীর সাক্ষাৎ করিবার জন্য জেব-উন্নিসা উদিপুরীর নিকট বিদায় চাহিল।

উদিপুরী বলিল, “কেন, তোমাকে কি ডাকিয়াছে?”

জে। না।

উ। তবে উপযাচক হইয়া তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না। তুমি বাদশাহের কন্যা।

জেব। আমার নিজের বিশেষ প্রয়োজন আছে।

উ। সাক্ষাৎ কর ত জিজ্ঞাসা করিও যে, কত আশরফি পাইলে এই গাঁওয়ারেরা আমাদিগকে ছাড়িয়া দিবে?

“করিব |” বলিয়া জেব-উন্নিসা বিদায় লইলেন। পরে চঞ্চলকুমারীর অনুমতি লইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। চঞ্চলকুমারী তাঁহাকে পূর্‍বদিনের মত সম্মান করিলেন, এবং রীতিমত স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন। শেষ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, উত্তম নিদ্রা হইয়াছিল ত?”