রাজসিংহ
জে। না। আপনি যেরূপ আজ্ঞা করিয়াছিলেন, তাহা পালন করিতে গিয়া ভয়ে ঘুমাই নাই।
চ। তবে কিছু স্বপ্নে দেখেন নাই?
জে। স্বপ্ন দেখি নাই। কিন্তু প্রত্যক্ষ কিছু দেখিয়াছি।
চ। ভাল, না মন্দ?
জে। ভাল, না মন্দ তাহা বলিতে পারি না–ভাল ত নহেই। কিন্তু সে বিষয়ে আপনার কাছে আমার ভিক্ষা আছে।
চ। বলুন।
জে। আর তাহা দেখিতে পাই কি?
চ। দৈবজ্ঞকে জিজ্ঞাসা না করিলে বলিতে পারি না। আমি পাঁচ সাত দিন পরে, দৈবজ্ঞের কাছে লোক পাঠাইব।
জে। আজ পাঠান যায় না?
চ। এত কি ত্বরা বাদশাহজাদী?
জে। এত ত্বরা, যদি আপনি এই মুহূর্ত্তে তাহা দেখাইতে পারেন, তবে আমি আপনার বাঁদী হইয়া থাকিতেই চাহিব।
চ। বিস্ময়কর কথা শাহজাদী! এমন কি সামগ্রী?
জেব-উন্নিসা উত্তর করিল না। তাহার চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। দেখিয়া চঞ্চলকুমারী দয়া করিল না। বলিল, “আপনি পাঁচ সাত দিন অপেক্ষা করুন, বিবেচনা করিব |”
তখন জেব-উন্নিসা, হিন্দু-মুসলমানের প্রভেদ ভুলিয়া গেল। যেখানে তাহার যাইতে নাই, সেখানে গেল। যে শয্যার উপর চঞ্চলকুমারী বসিয়া, তাহার উপর গিয়া দাঁড়াইল। তার পর ছিন্ন লতার মত সহসা চঞ্চলকুমারীর চরণে পড়িয়া গিয়া, চঞ্চলকুমারীর পায়ের উপর মুখ রাখিয়া, পদ্মের উপর পদ্মখানি উল্টাইয়া দিয়া, অশ্রুশিশিরে তাহা নিষিক্ত করিল। বলিল, “আমার প্রাণ রক্ষা কর! নহিলে আজ মরিব |”
চঞ্চলকুমারী তাহাকে ধরিয়া বসাইলেন–তিনিও হিন্দু মুসলমান মনে রাখিলেন না। তিনি বলিলেন, “শাহজাদী! আপনি যেমন কাল রাত্রিতে দ্বার খুলিয়া শুইয়াছিলেন, আজিও তাই করিবেন। নিশ্চিত আপনার মনস্কামনা সিদ্ধ হইবে |”
এই বলিয়া তিনি জেব-উন্নিসাকে বিদায় দিলেন।
এ দিকে উদিপুরী জেব-উন্নিসার প্রতীক্ষা করিতেছিল। কিন্তু জেব-উন্নিসা তাহার সহিত আর সাক্ষাৎ করিল না। নিরাশ হইয়া উদিপুরী স্বয়ং চঞ্চলকুমারীর কাছে যাইবার অনুমতি চাহিলেন।
সাক্ষাৎ হইলে উদিপুরী চঞ্চলকুমারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, কত আশরফি পাইলে চঞ্চলকুমারী ছাড়িয়া দিতে পারেন। চঞ্চলকুমারী বলিলেন, “যদি বাদশাহ ভারতবর্ষের সকল মসজিদ–মায় দিল্লীর জুম্মা মসজিদ ভাঙ্গিয়া ফেলিতে পারেন, আর ময়ূরতক্ত এখানে বহিয়া দিয়া যাইতে পারেন, আর বৎসর বৎসর আমাদিগকে রাজকর দিতে স্বীকৃত হয়েন, তবে তোমাদের ছাড়িয়া দিতে পারি |”
উদিপুরী ক্রোধে অধীর হইল। বলিল, “গাঁওয়ার ভুঁইঞার ঘরে এত স্পর্দ্ধা আশ্চর্য বটে!”