নির্মলকুমারী, উদিপুরী বেগম ও জেব-উন্নিসা বেগমকে উপযুক্ত স্থানে রাখিয়া, মহারাণী চঞ্চলকুমারীর নিকট গিয়া প্রণাম করিলেন। এবং আদ্যোপান্ত সমস্ত বিবরণ তাঁহার নিকট নিবেদন করিলেন। সকল কথা সবিশেষ শুনিয়া চঞ্চলকুমারী আগে উদিপুরীকে ডাকাইলেন। উদিপুরী আসিলে তাঁহাকে পৃথক আসনে বসিতে দিলেন; এবং তাঁহাকে সম্মান করিবার জন্য আপনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। উদিপুরী অত্যন্ত বিষণ্ণ ও বিনীতভাবে চঞ্চলকুমারীর নিকট আসিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে চঞ্চলকুমারীর সৌজন্য দেখিয়া মনে করিলেন ক্ষুদ্রপ্রাণ হিন্দু ভয়েই এত সৌজন্য করিতেছে। তখন ম্লেচ্ছকন্যা বলিল, “তোমরা মোগলের নিকট মৃত্যু বাসনা করিতেছ কেন?”
চঞ্চলকুমারী ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “আমরা তাঁহার নিকট মৃত্যু কামনা করি নাই। তিনি যদি সে সামগ্রী আমাদিগকে দিতে পারেন, সেই আশায় আসিয়াছেন। তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন যে, আমরা হিন্দু; যবনের দান গ্রহণ করি না |”
উদিপুরী ঘৃণার সহিত বলিল, “উদয়পুরের ভুঁইঞারা পুরুষানুক্রমে মুসলমানের কাছে এ দান স্বীকার করিয়াছেন। সুলতান্ আলাউদ্দীনের কথা ছাড়িয়া দিই; মোগল বাদশাহ আকব্বর শাহ, এবং তাঁহার পৌত্রের নিকটও রাণা রাজসিংহের কর্তব্যপুরুষেরা এ দান স্বীকার করিয়াছেন |”
চ। বেগম সাহেব! আপনি ভুলিয়া যাইতেছেন যে, সে আমরা দান বলিয়া স্বীকার করি নাই; ঋণ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলাম। আকব্বর বাদশাহের ঋণ, প্রতাপসিংহ নিজে পরিশোধ করিয়া গিয়াছেন। আপনার শ্বশুরের ঋণ এক্ষণে আমরা পরিশোধে প্রবৃত্ত হইয়াছি। তাহার প্রথম কিস্তি লইবার জন্য আপনাকে ডাকিয়াছি। আমার তামাকু নিবিয়া গিয়াছে। অনুগ্রহপূর্বক আমাকে তামাকুটা সাজিয়া দিন।
চঞ্চলকুমারী বেগমের প্রতি যেরূপ সৌজন্য প্রকাশ করিয়াছিলেন, বেগম যদি তাহার উপযোগী ব্যবহার করিতেন, তাহা হইলে বোধ করি, তাঁহাকে এ অপমানে পড়িতে হইত না। কিন্তু তিনি পরুষবাক্যে তেজস্বিনী চঞ্চলকুমারীর গর্ব উদ্রিক্ত করিয়াছেন–কাজেই এখন ফলভোগ করিতে হইল। তামাকু সাজার কথায়, সেই তামাকু সাজার নিমন্ত্রণপত্রখানা মনে পড়িল। উদিপুরীর সর্বশরীরে স্বেদোদ্গম হইতে লাগিল। তথাপি অভ্যস্ত গর্বকে হৃদয়ে পুন: স্থাপন করিয়া কহিলেন, “বাদশাহের বেগমে তামাকু সাজে না |”
চ। যখন তুমি বাদশাহের বেগম ছিলে, তখন তামাকু সাজিতে না। এখন তুমি আমার বাঁদী। তামাকু সাজিবে। আমার হুকুম।
উদিপুরী কাঁদিয়া ফেলিল–দু:খে নহে; রাগে। বলিল, “তোমার এত বড় স্পর্দ্ধা যে, আলম্গীর বাদশাহের বেগমকে তামাকু সাজিতে বল?”
চঞ্চল। আমার ভরসা আছে, আলম্গীর বাদশাহ স্বয়ং এখানে আসিয়া মহারাণার তামাকু সাজিবেন। তাঁহার যদি সে বিদ্যা না থাকে, তবে তুমি তাঁহাকে কাল শিখাইয়া দিবে। আজ আপনি শিখিয়া রাখ।
চঞ্চলকুমারী তখন পরিচারিকাকে আজ্ঞা দিলেন, “ইহা দ্বারা তামাকু সাজাইয়া লও |”
উদিপুরী উঠে না।
তখন পরিচারিকা বলিল, “ছিলিম উঠাও |”
উদিপুরী তথাপি উঠিল না। তখন পরিচারিকা তাহার হাত ধরিয়া তুলিতে আসিল। অপমানভয়ে, কম্পিতহৃদয়ে শাহানশাহের প্রেয়সী মহিষী ছিলিম তুলিতে গেলেন। তখন ছিলিম পর্যন্ত পৌঁছিলেন না। আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া, এক পা বাড়াইতে না বাড়াইতে থর থর করিয়া কাঁপিয়া প্রস্তরনির্মিত হর্ম্ম্যতলে পড়িয়া গেলেন। পরিচারিকা ধরিয়া ফেলিল–আঘাত লাগিল না। উদিপুরী হর্মতলে শয়ন করিয়া মূর্ছিতা গেলেন।





