ফিরিয়া আসিয়া অপরাহ্নে, যে মুখে ঔরঙ্গজেব সসৈন্য রন্ধ্রমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন, পুনশ্চ রন্ধ্রের সেই মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, সেখানেও প্রত্যক্ষমূর্‍তি মৃত্যু, তাঁহাকে সসৈন্যে গ্রাস করিবার জন্য দাঁড়াইয়া আছে। রন্ধ্রের সে মুখও, সেইরূপ অলঙ্ঘ্য পর্‍বতপ্রমাণ বৃক্ষপ্রাকারে বন্ধ; নির্গমের উপায় নাই। পর্‍বতোপরি রাজপুতসেনা পূর্‍ববৎ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।

কিন্তু নির্গত না হইলে ত নিশ্চিত সসৈন্য মৃত্যু। অতএব সমস্ত মোগল সেনাপতিকে ডাকিয়া ঔরঙ্গজেব স্তুতি মিনতি, উৎসাহবাক্য এবং ভয়প্রদর্শনের দ্বারা পথ মুক্ত করিবার জন্য প্রাণ পর্‍যন্ত পতন করিতে স্বীকৃত করাইলেন। সেনাপতিগণ সেনা লইয়া পুনশ্চ বৃক্ষপ্রাকার আক্রমণ করিলেন। এবার একটু সুবিধাও ছিল–পথপরিষ্কারক সেনাও উপস্থিত ছিল। মোগলেরা মরণ তৃণজ্ঞান করিয়া বৃক্ষরাজি ছিন্ন ও আকৃষ্ট করিতে লাগিল। কিন্তু সে ক্ষণমাত্র। পর্‍বতশিখর হইতে যে লৌহ ও পাষাণবৃষ্টি হইতেছিল–ভাদ্রের বর্‍ষায় যেমন ধান্যক্ষেত্র ডুবিয়া যায়, মোগল সেনা তাহাতে তেমনই ডুবিয়া গেল।

তারপর বিপদের উপর বিপদ, সম্মুখস্থ পর্‍বতসানুদেশে রাজসিংহের শিবির। তিনি দূর হইতে মোগল সেনার প্রত্যাবর্‍তন জানিতে পারিয়া, তোপ সাজাইয়া সম্মুখে প্রেরণ করিলেন।

রাজসিংহের কামান ডাকিল। বৃক্ষপ্রাকার লঙ্ঘিত করিয়া রাজসিংহের গোলা ছুটিল–হস্তী, অশ্ব, পত্তি, সেনাপতি সব চূর্ণ হইয়া গেল। মোগল সেনা রন্ধ্রমধ্যে হটিয়া গিয়া, ক্রুর সর্‍প যেমন অগ্নিভয়ে কুণ্ডলী করিয়া বিবরে লুকায়, মোগল সেনা রন্ধ্রবিবরে সেইরূপ লুকাইল। শাহান‍শাহ বাদশাহ, হীরকমণ্ডিত শ্বেত উষ্ণীষ মস্তক হইতে খুলিয়া দূরে নিক্ষিপ্ত করিয়া, জানু পাতিয়া, পর্‍বতের কাঁকর তুলিয়া আপনার মাথায় দিলেন। দিল্লীর বাদশাহ রাজপুত ভুঁইঞার নিকট সসৈন্যে পিঞ্জরাবদ্ধ মূষিক। একটা মূষিকের আহার পাইলেও আপাতত: তাঁর প্রাণরক্ষা হইতে পারে।

তখন ভারতপতি ক্ষুদ্রা রাজপুতকুলবালাকে উদ্ধারকারিণী মনে করিয়া তাহার পারাবত উড়াইয়া দিলেন।