রাজসিংহ
তখন আর কি হইতে পারে? এক মাত্র ভরসা–উদয়পুরে যাইবার যদি অন্য পথ থাকে। ঔরঙ্গজেবের আদেশে চারি দিকে অশ্বারোহী পদাতি অন্য পথের সন্ধানে ছুটিল। ঔরঙ্গজেব নির্মলকুমারীকেও জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইল। নির্মলকুমারী বলিল, “আমি পরদানশীন স্ত্রীলোক–পথের কথা আমি কি জানি?” কিন্তু অল্পকাল মধ্যে সংবাদ আসিল যে উদয়পুরে যাইবার আর একটা পথ আছে। একজন মোগল সওদাগরের সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়াছে, সে পথ দেখাইয়া দিবে। মনসবদার সে পথ দেখিয়া আসিয়াছে। সে একটি পার্বত্য রন্ধ্রপথ; অতিশয় সঙ্কীর্ণ। কিন্তু পথটা সোজা পথ, শীঘ্র বাহির হওয়া যাইবে। সে দিকে কোন রাজপুত দেখা যাইতেছে না। যে মোগল সংবাদ দিয়াছে, সে বলিতেছে যে, সে দিকে কোন রাজপুত সেনা নাই।
ঔরঙ্গজেব ভাবিলেন। বলিলেন, “নাই, কিন্তু লুকাইয়া থাকিতে পারে |”
যে মনসবদার পথ দেখিয়া আসিয়াছিল–বখত খাঁ–সে বলিল যে, “যে মোগল আমাকে প্রথমেই এই পথের সন্ধান দেয়, তাহাকে আমি পর্বতের উপরে পাঠাইয়া দিয়াছি। সে যদি রাজপুত সেনা দেখিতে পায়, তবে আমাকে সঙ্কেত করিবে |”
ঔরঙ্গজেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কি আমার সিপাহী?”
বখ্ত খাঁ। না, সে একজন সওদাগর। উদয়পুরে শাল বেচিতে গিয়াছিল। এখন শিবিরে বেচিতে আসিয়াছিল।
ঔ। ভাল, সেই পথেই তবে ফৌজ লইয়া যাও।
তখন বাদশাহী হুকুমে, ফৌজ ফিরিল। ফিরিল–কেন না, কিছু পথ ফিরিয়া আসিয়া তবে রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিতে হয়। ইহাতেও বিশেষ বিপদ–তবে জালনিবদ্ধ বৃহৎ রোহিত আর কোন দিকে যায়? যেরূপ পারম্পর্যের সহিত মোগলসেনা আসিয়াছিল–তাহা আর রক্ষিত হইতে পারিল না। যে ভাগ আগে ছিল, তাহা পিছে পড়িল; যাহা পিছনে ছিল, তাহা আগে চলিল। সোনার তৃতীয় ভাগ আগে আগে চলিল। বাদশাহ হুকুম দিলেন যে, তাম্বু ও মোট-ঘাট ও বাজে লোক সকল এক্ষণে উদয়সাগরের পথে যাক্–পরে সেনার পশ্চাতে তাহারা আসিবে। তাহাই হইল। ঔরঙ্গজেব নিজে, পদাতি ও ছোট কামান ও গোলন্দাজ সেনা লইয়া রন্ধ্রপথে চলিলেন। আগে আগে বখ্ত খাঁ।
দেখিয়া রাজসিংহ, সিংহের মত লাফ দিয়া, পর্বত হইতে অবতরণ করিয়া মোগল সেনার মধ্যে পড়িলেন। অমনই মোগল সেনা দ্বিখণ্ড হইযা গেল–ছুরিকাঘাতে যেন ফুলের মালা কাটিয়া গেল। এক ভাগ ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে রন্ধ্রমধ্যে প্রবিষ্ট; আর এক ভাগ; এখন পূর্বপথে, কিন্তু রাজসিংহের সম্মুখে।
মোগলের বিপদের উপর বিপদ এই যে, যেখানে হাতী, ঘোড়া, দোলার উপর বাদশাহের পৌরাঙ্গনাগণ, ঠিক সেইখানে, পৌরাঙ্গনাদিগের সম্মুখে, রাজসিংহ সসৈন্যে অবতীর্ণ হইলেন। দেখিয়া, যেমন চিল পড়িলে চড়াইয়ের দল কিল-বিল করিয়া উঠে, এই সসৈন্য গরুড়কে দেখিয়া রাজাবরোধের কালভুজঙ্গীর দল তেমনই আর্তনাদ করিয়া উঠিল। এখানে যুদ্ধের নামমাত্র হইল না। যে সকল আহদীয়ান্ তাঁহাদের প্রহরায় নিযুক্ত ছিল–তাহারা কেহই অস্ত্রসঞ্চালন করিতে পারিল না–পাছে বেগমেরা আহত হয়েন। রাজপুতেরা বিনা যুদ্ধে আহদীদিগকে বন্দী করিল। সমস্ত মহিষীগণ এবং তাঁহাদিগের অসংখ্য অশ্বারোহিণী অনুচরীবর্গ, বিনা যুদ্ধে রাজসিংহের বন্দিনী হইলেন।
মাণিকলাল রাজসিংহের নিকটে নিকটে থাকেন–তিনি রাজসিংহের অতিশয় প্রিয়। মাণিকলাল আসিয়া যুক্তকরে নিবেদন করিলেন, “মহারাজাধিরাজ! এখন এই মার্জরী সম্প্রদায় লইয়া কি করা যায়? আজ্ঞা হয় ত উদর পুরিয়া দধিদুগ্ধ ভোজনের জন্য ইহাদের উদয়পুরে পাঠাইয়া দিই |”