দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : নয়নবহ্নিও বুঝি জ্বলিয়াছিল

শাহজাদা আকব্বর শাহকে আগে পাঠাইয়া, খোদ বাদশাহ উদয়সাগরতীরে শিবির ফেলিয়াছেন। পাশ্চাত্য পরিব্রাজক, মোগলদিগের দিল্লী দেখিয়া বলিয়াছিলেন, দিল্লী একটি বৃহৎ শিবির মাত্র। পক্ষান্তরে ইহা বলা যাইতে পারে যে, মোগল বাদশাহদিগের শিবির একটি দিল্লী নগরী। নগরের যেমন চক, তেমনই বড় বড় চক সাজাইয়া তাম্বু পাতা হইত। এমন অসংখ্য চত্বরশ্রেণীতে একটি বস্ত্রনির্‍মিতা মহানগরীর সৃষ্টি হইত। সকলের মধ্যে বাদশাহের তাম্বুর চক। দিল্লীতে যেমন মহার্ঘ হর্‍মশ্রেণীমধ্যে বাদশাহ বাস করিতেন, তেমনই মহার্ঘ হর্‍মশ্রেণীমধ্যে এখানেও বাস করিতেন; তেমনই দরবার, আমখাস, গোসলখানা, রঙ‍মহাল।7 এই সকল বাদশাহী তাম্বু কেবল বস্ত্রনির্‍মিত নহে। ইহার লৌহ পিত্তলের সজ্জা ছিল–এবং ইহাতে দ্বিতল ত্রিতল কক্ষও থাকিত। সম্মুখে দিল্লীর দুর্গের ফটকের ন্যায় বড় ফটক। বাদশাহী তাম্বু সকলের বস্ত্রনির্‍মিত প্রাচীর বা পট পাদক্রোশ দীর্ঘ, সমস্তই চারু কারুকার্‍যখচিত পট্টবস্ত্রনির্‍মিত। যেমন দুর্গপ্রাচীরে বুরুজ গম্বুজ প্রভৃতি থাকিত, ইহাতে তাহা ছিল। পিত্তলের স্তম্ভের দ্বারা এই প্রাচীর রক্ষিত হইত। কক্ষসকলের বাহিরে উজ্জ্বল রক্তিম পটের শোভা, ভিতরে সমস্ত দেয়াল “ছবি” মোড়া। ছবি, আমরা এখন যাহাকে বলি তাই, অর্থাৎ কাচের পরকলার ভিতর চিত্র। দরবার-তাম্বুতে শিরোপরে সুবর্ণখচিত চন্দ্রাতপ–নিম্নে বিচিত্র গালিচা, মধ্যে রত্নমণ্ডিত রাজসিংহাসন। চারি দিকে অস্ত্রধারিণী তাতারসুন্দরীগণের প্রহরা।

রাজপ্রাসাদাবলীর পরে আমীর ওমরাহদিগের পটমণ্ডপরাজির শোভা। এমন শোভা অনেক ক্রোশ ব্যাপিয়া। কোন পটনির্‍মিত অট্টালিকা রক্তবর্ণ, কোনটি পীতবর্ণ, কোনটি শ্বেত, কোনটি হরিৎকপিশ, কোনটি নীল; সকলের সুবর্ণকলস চন্দ্রসূর্‍যের কিরণে ঝলসিতে থাকে। তীরে, এই সকলের চারিদিকে দিল্লীর চকের ন্যায় বিচিত্র পণ্যবীথিকা–বাজারের পর বাজার। সহসা বাদশাহের শুভাগমনে উদয়সাগরতীরে এই রমণীয় মহানগরীর সৃষ্টি হইল। দেখিয়া লোক বিস্ময়াপন্ন হইল।

বাদশাহ যখন শিবিরে আসিতেন, তখন অন্ত:পুরবাসিনী সকলেই সঙ্গে আসিত। বেগমেরা সকলেই আসিত। এবারও আসিয়াছিল। যোধপুরী, উদিপুরী, জেব-উন্নিসা সকলেই আসিয়াছিল। যোধপুরীর সঙ্গে নির্‍মলকুমারীও আসিয়াছিল। দিল্লীর রঙ‍মহালে যেমন তাহাদের পৃথক পৃথক মন্দির ছিল, শিবিরে রঙ‍মহালেও তেমনই তাহাদের পৃথক পৃথক মন্দির ছিল।

এই সুখের শিবিরে, ঔরঙ্গজেব রাত্রিকালে যোধপুরীর মহালে আসিয়া সুখে কথোপকথন করিতেছেন। নির্‍মলকুমারীও সেখানে উপস্থিত।

“ইম্‌‍‍‌লি বেগম!” বলিয়া বাদশাহ নির্‍মল কে ডাকিলেন। নির্‍মল কে তিনি ইতিপূর্‍বে “ইমলি বেগম” বলিতেন, কিন্তু বাক্যের যন্ত্রণা ভুগিয়া এক্ষণে “ইম্‌‍‍‌লি বেগম” বলিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বাদশাহ নির্‍মল কে বলিলেন, “ইমলি বেগম! তুমি আমার, না রাজপুতের?” নির্‍মল যুক্তকরে বলিল, “দুনিয়ার বাদশাহ দুনিয়ার বিচার করিতেছেন, এ কথারও তিনি বিচার করুন |”


7- যাহাকে মোগল বাদশাহেরা গোসলখানা বলিতেন, তাহাতে আধুনিক বৈঠকখানার মত কার্‍য হইত। সেইটি আয়েশের স্থান।