রাজসিংহ
নি। শাহান-শাহ! আপনি কখনও কি শুনেন নাই যে, হিন্দু স্ত্রীলোকেরা ব্রত-নিয়ম করে? ব্রত-নিয়ম জন্য এক দিন, দুই দিন, তিন দিন নিরম্বু উপবাস করে? শুনেন নাই, শরণা ধরণার জন্য অনিয়মিতকাল উপবাস করে? শুনেন নাই, তারা কখন কখন উপবাস করিয়া ইচ্ছাপূর্বক প্রাণত্যাগ করে? জাঁহাপনা, এ দাসীও তা পারে। ইচ্ছা হয়, আমার মৃত্যু পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়া দেখুন।
ঔরঙ্গজেব দেখিলেন, এ মেয়েকে ভয় দেখাইয়া কিছু হইবে না। মারিয়া ফেলিলেও কিছু হইবে না। পীড়ন করিলে কি হয় বলা যায় না। কিন্তু তার পূর্বে একবার প্রলোভনের শক্তিটা পরীক্ষা করা ভাল। অতএব বলিলেন, “ভাল, নাই তোমাকে পীড়ন করিলাম। তোমাকে ধনদৌলত দিয়া বিদায় করিব। তুমি এ সকল কথা আমার নিকট যথার্থ প্রকাশ কর |”
নি। রাজপুতকন্যা যেমন মৃত্যুকে ঘৃণা করে, ধন-দৌলতকেও তেমনই। সামান্যা স্ত্রীলোক আমি–নিজগুণে আমাকে বিদায় দিন।
ঔরঙ্গ। দিল্লীর বাদশাহের অদেয় কিছু নাই। তাঁহার কাছে প্রার্থনীয় তোমার কি কিছুই নাই?
নি। আছে। নির্বিঘ্নে বিদায়।
ঔ। কেবল সেইটি এখন পাইতেছ না। তা ছাড়া আর জগতে তোমার প্রার্থনা করিবার, কি ভয় করিবার কিছু নাই?
নি। প্রার্থনার আছে বৈ কি? কিন্তু দিল্লীর বাদশাহের রত্নাগারে সে রত্ন নাই।
ঔ। এমন কি সামগ্রী?
নি। আমরা হিন্দু, আমরা জগতে কেবল ধর্মকেই ভয় করি, ধর্মই কামনা করি। দিল্লীর বাদশাহ ম্লেচ্ছ, আর দিল্লীর বাদশাহ ঐশ্বর্য্যশালী। দিল্লীর বাদশাহের সাধ্য কি যে, আমার কাম্য বস্তু দিতে পারেন, কি লইতে পারেন?
দিল্লীশ্বর নির্মলকুমারী সাহস ও চতুরতা দেখিয়া, ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছিলেন, কিন্তু এই কটূক্তিতে পুনর্বার ক্রুব্ধ হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “বটে! বটে! ঐ কথাটা ভুলিয়া গিয়াছিলাম |” তখন তিনি একজন তাতারীকে আদেশ করিলেন, “যা! বাবর্চি মহল হইতে কিছু গোমাংস আনিয়া, দুই তিন জনে ধরিয়া ইহার মুখে গুঁজিয়া দে |”
নির্মল তাহাতেও টলিল না। বলিল, “জানি, আপনাদিগের সে বিদ্যা আছে। সে বিদ্যার জোরেই এই সোণার হিন্দুস্থান কাড়িয়া লইয়াছেন। জানি, গোরুর পাল সম্মুখে রাখিয়া লড়াই করিয়া মুসলমান হিন্দুকে পরাস্ত করিয়াছে–নহিলে রাজপুতের বাহুবলের কাছে মুসলমানের বাহুবল, সমুদ্রের কাছে গোষ্পদ। কিন্তু আবার একটা কথা আপনাকে মনে করিয়া দিতে হইল। শুনেন নাই যে, রাজপুতের মেয়ে বিষ না লইয়া এক পা চলে না? আমার নিকটে এমন তীব্র বিষ আছে যে, আপনার ভৃত্যগণ গোমাংস লইয়া এ ঘরে পা দেওয়ার পরেও যদি তাহা আমি মুখে দিই, তবে জীবন্তে আর আমার মুখে কেহ গোমাংস দিতে পারিবে না। জাঁহাপনা! আপনার বড় ভাই দারাশেকোকে বধ করিয়া তাহার দুইটা কবিলা কাড়িয়া আনিতে গিয়াছিলেন–পারিয়াছিলেন কি?–অধম খ্রিষ্টিয়ানীটা আসিয়াছিল জানি, রাজপুতানী দিল্লীর বাদশাহের মুখে সাত পয়জার মারিয়া স্বর্গে চলিয়া যায় নাই কি? আমিও এখনই তোমার মুখে সাত পয়জার মারিয়া স্বর্গে চলিয়া যাইব |”
বাদশাহ বাকশূন্য। যিনি পৃথিবীপতি বলিয়া খ্যাত, পৃথিবীময় যাঁহার গৌরব ঘোষিত, যিনি সমস্ত ভারতবর্ষের ত্রাস, তিনি আজ এই অনাথা, নি:সহায় অবলার নিকট অপমানিত–পরাস্ত। ঔরঙ্গজেব পরাজয় স্বীকার করিলেন। মনে মনে বলিলেন, “এ অমূল্য রত্ন, ইহাকে নষ্ট করা হইবে না। আমি ইহাকে বশীভূত করিব |” প্রকাশ্যে অতি মধুরস্বরে বলিলেন, “তোমার নাম কি, পিয়ারী?”