রাজসিংহ
বাদশাহ বলিলেন, “এখানে কাহার কাছে আসিয়াছিলে?”
নির্মল । হজরৎ বাদশাহ বেগম উদিপুরী সাহেবার কাছে।
বাদশাহ। কি বলিলে? উদয়পুর হইতে উদিপুরীর কাছে? কেন?
নি। পত্র ছিল।
বাদ। কাহার পত্র?
নি। মহারাণার রাজমহিষীর।
বাদ। কৈ সে পত্র?
নি। হজরৎ বেগম সাহেবাকে তাহা দিয়াছি।
বাদশাহ বড় বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “আমার সঙ্গে এসো |”
নির্মলকে সঙ্গে লইয়া বাদশাহ উদিপুরীর মন্দিরে গমন করিলেন। দ্বারে নির্মলকে দাঁড় করাইয়া, তাতারী প্রহরিণীদিগকে বলিলেন, “ইহাকে ছাড়িও না |” নিজে উদিপুরীর শয্যাগৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, উদিপুরী ঘোর নিদ্রাভিভূত। তাহার বিছানায় পত্রখানা পড়িয়া আছে। ঔরঙ্গজেব তাহা লইয়া পাঠ করিলেন। পত্রখানা, তখনকার রীতিমত ফার্সীতে লেখা।
পত্র পাঠ করিয়া, নিদাঘসন্ধ্যাকাদম্বিনী তুল্য ভীষণ কান্তি লইয়া ঔরঙ্গজেব বাহিরে আসিলেন। নির্মলকে বলিলেন, “তুই কি প্রকারে এই মহাল মধ্যে প্রবেশ করিলি?”
নির্মল যুক্তকরে বলিল, “বাঁদীর অপরাধ মার্জনা হউক–আমি এ কথার উত্তর দিব না |”
ঔরঙ্গজেব বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “কি এত হেমাকৎ? আমি দুনিয়ার বাদশাহ–আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুই উত্তর দিবি না?”
নির্মল করজোড়ে বলিল, “দুনিয়া হুজুরের। কিন্তু রসনা আমার। আমি যাহা না বলিব, দুনিয়ার বাদশাহ তাহা কিছুতেই বলাইতে পারিবেন না |”
ঔ। তা না পারি, যে রসনার বড়াই করিতেছ, তা এখনই তাতারী প্রহরিণীর হাতে কাটিয়া ফেলিয়া কুকুরকে খাওয়াইতে পারি।
নি । দিল্লীশ্বরের মর্জি! কিন্তু তাহা হইলে, যে সংবাদ আপনি খুঁজিতেছেন, তা প্রকাশের পথ চিরকালের জন্য বন্ধ হইবে।
ঔ। সেই জন্য তোমার জিভ রাখিলাম। তোমার প্রতি এই হুকুম দিতেছি যে, আগুন জ্বালিয়া তোমাকে কাপড়ে মুড়িয়া, একটু একটু করিয়া তাতারীরা পোড়াইতে থাকুক। আমার কথায় যাহা বলিবে না, আগুনের জ্বালায় তাহা বলিবে।
নির্মলকুমারী হাসিল। বলিল, “হিন্দুর মেয়ে আগুনে পুড়িয়া মরিতে ভয় করে না। হিন্দুস্থানের বাদশাহ কি কখনও শুনেন নাই যে, হিন্দুর মেয়ে, হাসিতে হাসিতে স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়া মরে? আপনি যে মরণের ভয় দেখাইতেছেন, আমার মা মাতামহী প্রভৃতি পুরুষানুক্রমে সেই আগুনেই মরিয়াছেন। আমিও কামনা করি, যেন ঈশ্বরের কৃপায় আমিও স্বামীর পাশে স্থান পাইয়া আগুনেই জীবন্ত পুড়িয়া মরি |”
বাদশাহ মনে মনে বলিলেন, “বাহবা! বাহবা!” প্রকাশ্যে বলিলেন, “সে কথার মীমাংসা পরে করিব। আপাতত: তুমি এই মহালের একটা কামরার ভিতর চাবিবন্ধ থাক। ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হইলে কিছু খাইতে পারিবে না। তবে যখন নিতান্ত প্রাণ যায় বিবেচনা করিবে, তখন কবাটে ঘা মারিও, প্রহরীরা দ্বার খুলিয়া দিয়া আমার কাছে লইয়া যাইবে। তখন আমার নিকট সকল উত্তর দিলে, পান-আহার করিতে পাইবে |”