রাজসিংহ
অত্যন্ত হর্ষসূচক ঘোর রব শুনিয়া রাজসিংহ পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, ব্যাপার কি? দেখিলেন, দুই পার্শ্বে রাজপুতসেনা সারি দিয়াছে–মধ্যে বিশাললোচনা, সহাস্যবদনা কোন দেবী আসিতেছেন। হয় কোন দেবী মনুষ্যমূর্তিা ধারণ করিয়াছেন–নয় কোন মানবীকে বিধাতা দেবীর মূর্তিেতে গঠিয়াছেন–রাজপুতেরা মনে করিল, চিতোরাধিষ্ঠাত্রী রাজপুতকুলরক্ষিণী ভগবতী এ সঙ্কটে রাজপুতকে রক্ষা করিতে স্বয়ং রণে অবতীর্ণ হইয়াছেন। তাই তাহারা জয়ধ্বনি করিতেছিল।
রাজসিংহ দেখিলেন–এ ত মানবী, কিন্তু সামান্যা মানবী নহে। ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, দোলা কোথায়?”
একজন পিছু হইতে বলিল, “দোলা এই দিকে আছে |”
রাণা বলিলেন, “দেখ, দোলা খালি কি না?”
সৈনিক বলিল, “দোলা খালি। কুমারীজী মহারাজের সামনে |”
চঞ্চলকুমারী তখন রাজসিংহকে প্রণাম করিলেন। রাণা জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাজকুমারি–আপনি এখানে কেন?”
চঞ্চল বলিলেন, “মহারাজ! আপনাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি। প্রণাম করিয়াছি–এখন একটি ভিক্ষা চাহি। আমি মুখরা–স্ত্রীলোকের শোভা যে লজ্জা, তাহা আমাতে নাই, ক্ষমা করিবেন। ভিক্ষা যাহা চাহি–তাহাতে নিরাশ করিবেন না |”
চঞ্চলকুমারী হাস্য ত্যাগ করিয়া, জোড়হাত করিয়া কাতর স্বরে এই কথা বলিলেন। রাজসিংহ বলিলেন, “তোমারই জন্য এত দূর আসিয়াছি–তোমাকে অদেয় কিছুই নাই–কি চাও, রূপনগরের কন্যে?”
চঞ্চলকুমারী আবার জোড়হাত করিয়া বলিল, “আমি চঞ্চলমতি বালিকা বলিয়া আপনাকে আসিতে লিখিয়াছিলাম, কিন্তু আমি নিজের মন আপনি বুঝিতে পারি নাই। আমি এখন মোগলসম্রাটের ঐশ্বর্যেকর কথা শুনিয়া বড় মুগ্ধ হইয়াছি। আপনি অনুমতি করুন–আমি দিল্লী যাইব |”
রাজসিংহ বিস্মিত ও প্রীত হইলেন। বলিলেন, “তোমার দিল্লী যাইতে হয় যাও–আমার আপত্তি নাই–কিন্তু আপাতত: তুমি যাইতে পাইবে না। যদি এখন তোমাকে ছাড়িয়া দিই, মোগল মনে করিবে যে, প্রাণভয়ে ভীত হইয়া তোমাকে ছাড়িয়া দিলাম। আগে যুদ্ধ শেষ হউক–তার পর তুমি যাইও। আর তোমার মনের কথা যে বুঝি নাই, তাহা মনে করিও না। আমি জীবিত থাকিতে তোমাকে দিল্লী যাইতে হইবে না। জোওয়ান সব–আগে চল |”
তখন চঞ্চলকুমারী মৃদু হাসিয়া, মর্ম|ভেদী মৃদু কটাক্ষ করিয়া, দক্ষিণ হস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলিস্থিত হীরকাঙ্গুরীয় বাম হস্তের অঙ্গুলিদ্বয়ের দ্বারা ফিরাইয়া রাজসিংহকে দেখাইতে দেখাইতে বলিলেন, “মহারাজ! এই আঙ্গটিতে বিষ আছে। দিল্লীতে না যাইতে দিলে, আমি বিষ খাইব |”
রাজসিংহ তখন হাসিলেন–বলিলেন, “অনেক্ষণ বুঝিয়াছি চঞ্চলকুমারী–রমণীকুলে তুমি ধন্যা। কিন্তু তুমি যাহা ভাবিতেছ, তাহা হইবে না। আজ রাজপুতের বাঁচা হইবে না; আজ রাজপুতকে মরিতেই হইবে–নহিলে রাজপুতনামে বড় কলঙ্ক হইবে। আমরা যতক্ষণ না মরি–ততক্ষণ তুমি বন্দী। আমরা মরিলে তুমি যেখানে ইচ্ছা, সেইখানে যাইও |”
চঞ্চলকুমারী হাসিল–অতিশয় প্রণয়প্রফুল্ল, ভক্তিপ্রণোদিত, সাক্ষাৎ মহাদেবের অনিবার্যষ এক কটাক্ষবাণ রাজসিংহের উপর ত্যাগ করিল। মনে মনে বলিতে লাগিল, “বীরচূড়ামণি! আজি হইতে আমি তোমার দাসী হইলাম! যদি তোমার দাসী না হই–তবে চঞ্চল কখনই প্রাণ রাখিবে না|” প্রকাশ্যে বলিল, “মহারাজ! দিল্লীশ্বর যাহাকে মহিষী করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, সে কাহারও বন্দী নহে। এই আমি মোগল সৈন্যসম্মুখে চলিলাম–কাহার সাধ্য রাখে দেখি?”