তখন “দীন্! দীন্!” শব্দে পঞ্চশত মোগল অশ্বারোহী কালান্তক যমের ন্যায় পর্বশতে আরোহণ করিল। পর্ব>ত অনুচ্চ, ইহা পূর্বেনই কথিত হইয়াছে–শিখরদেশে উঠিতে তাহাদের বড় কালবিলম্ব হইল না। কিন্তু পর্বচতশিখরে উঠিয়া দেখিল যে, কেহ ত পর্ব্বতোপরি নাই। যে রন্ধ্রপথমধ্যে প্রবেশ করিয়া তিনি নিজে পরাভূত হইয়া ফিরিয়া আসিতেছিলেন, এখন মবারক বুঝিলেন যে, সমুদায় দস্যু–মবারকের বিবেচনায় তাহারা রাজপুত দস্যু ভিন্ন আর কিছুই নহে–সেই রন্ধ্রপথে আছে। তাহার দ্বিতীয় মুখ রোধ করিয়া, তাহাদিগের বিনাশসাধন করিবেন, মবারক এইরূপ মনে মনে স্থির করিলেন। হাসান আলি অপর মুখে কামান পাতিয়া বসিয়া আছেন, এই ভাবিয়া, তিনি সেই রন্ধ্রের ধারে ধারে সৈন্য লইয়া চলিলেন। ক্রমে পথ প্রশস্ত হইয়া আসিল; তখন মবারক পাহাড়ের ধারে আসিয়া দেখিলেন–চল্লিশ জনের অনধিক রাজপুত, শিবিকা সঙ্গে রুধিরাক্ত কলেবরে সেই পথে চলিতেছে। মবারক বুঝিলেন যে, অবশ্য ইহারা নির্গমপথ জানে; ইহাদের উপর দৃষ্টি রাখিয়া ধীরে ধীরে চলিলে, রন্ধ্রদ্বারে উপস্থিত হইব। তাহা হইলে যেরূপ পথে রাজপুতেরা পর্বরত হইতে নামিয়াছিল, সেইরূপ অন্য পথ দেখিতে পাইব। রাজপুতেরা যে আগে উপরে ছিল, পরে নামিয়াছে, তাহার সহস্র চিহ্ন দেখা যাইতেছিল। মবারক রাজপুতদিগের উপর দৃষ্টি রাখিয়া ধীরে ধীরে চলিতে লাগিলেন। কিছু পরে দেখিলেন, পাহাড় ঢালু হইয়া আসিতেছে, সম্মুখে নির্গমের পথ। মবারক অশ্ব-সকল তীরবেগে চালাইয়া পর্বড়ততলে নামিয়া রন্ধ্রমুখ বন্ধ করিলেন। রাজপুতেরা রন্ধ্রের বাঁক ফিরিয়া যাইতেছিল–সুতরাং তাহারা আগে রন্ধ্রমুখে পৌঁছিতে পারিল না। মোগলেরা পথরোধ করিয়া রন্ধ্রমুখে কামান বসাইল; এবং আগতপ্রায় রাজপুতগণকে উপহাস করিবার জন্য তাহার বজ্রনাদ একবার শুনাইল–“দীন্! দীন্!” শব্দের সঙ্গে পর্বাতে সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইল। শুনিয়া উত্তরস্বরূপ রন্ধ্রের অপর মুখে হাসান আলিও কামানের আওয়াজ করিলেন; আবার পর্বাতে পর্বধতে প্রতিধ্বনি বিকট ডাক ডাকিল। রাজপুতগণ শিহরিল–তাহাদের কামান ছিল না।

রাজসিংহ দেখিলেন, আর কোন মতেই রক্ষা নাই। তাঁহার সৈন্যের বিশগুণ সেনা, পথের দুই মুখ বন্ধ করিয়াছে–পথান্তর নাই–কেবল যমমন্দিরের পথ খোলা। রাজসিংহ স্থির করিলেন, সেই পথে যাইবেন। তখন সৈনিকগণকে একত্রিত করিয়া বলিতে লাগিলেন–“ভাই বন্ধু, যে কেহ সঙ্গে থাক, আজি সরলান্ত:করণে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাহিতেছি। আমারই দোষে এ বিপদ ঘটিয়াছে–পর্বসত হইতে নামিয়াই এ দোষ করিয়াছি। এখন এই গলির দুই মুখ বন্ধ–দুই মুখেই কামান শুনিতেছি! দুই মুখে আমাদের বিশগুণ মোগল দাঁড়াইয়া আছে–সন্দেহ নাই। অতএব আমাদিগের বাঁচিবার ভরসা নাই। নাই–তাহাতেই বা ক্ষতি কি? রাজপুত হইয়া কে মরিতে কাতর? সকলেই মরিব–একজনও বাঁচিব না–কিন্তু মারিয়া মরিব। যে মরিবার আগে দুইজন মোগল না মারিয়া মরিবে–সে রাজপুত নহে। রাজপুতেরা শুন–এ পথে ঘোড়া ছুটে না–সবাই ঘোড়া ছাড়িয়া দাও। এসো, আমরা তরবারি হাতে লাফাইয়া গিয়া তোপের উপর পড়ি। তোপ ত আমাদেরই হইবে–তার পর দেখা যাইবে, কত মোগল মারিয়া মরিতে পারি |”

তখন রাজপুতগণ, অশ্ব হইতে লাফাইয়া পড়িয়া, একত্র অসি নিষ্কোষিত করিয়া “মহারাণাকি জয়” বলিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখকান্তি দেখিয়া রাজসিংহ বুঝিলেন যে, প্রাণরক্ষা না হউক–একটি রাজপুতও হটিবে না। সন্তুষ্টচিত্তে রাণা আজ্ঞা দিলেন, “দুই দুই করিয়া সারি দাও |” অশ্বপৃষ্ঠে সবে একে একে যাইতেছিল–পদব্রজে দুইয়ে দুইয়ে রাজপুত চলিল–রাণা সর্বা গ্রে চলিলেন। আজ আসন্নমৃত্যু দেখিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্ত।

এমন সময়ে সহসা পর্বলতরন্ধ্রে কম্পিত করিয়া, পর্ব তে প্রতিধ্বনি তুলিয়া, রাজপুতসেনা শব্দ করিল, “মাতাজীকি জয়! কালীমায়ীকি জয়!”