এই বলিয়া মাণিকলাল, রাণার প্রদত্ত আশরফির মধ্যে একটা পিসীর সম্মুখে ফেলিয়া দিল; এবং কন্যাকে তাঁহার কাছে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, “যা! তোর দিদির কোলে গিয়া বস |”

পিসীঠাকুরাণী কিছু লোভে পড়িলেন। মনে বিলক্ষণ জানিতেন যে, এক মোহরে ঐ শিশুর এক বৎসর গ্রাসাচ্ছদন চলিতে পারে–মাণিকলাল কেবল দুই মাসের করার করিতেছে; অতএব কিছু লাভের সম্ভাবনা। তার পর, মাণিক রাজদরবারে চাকরি স্বীকার করিয়াছে–চাহি কি, বড়মানুষ হইতে পারে, তা হইলে কি পিসীকে কখন কিছু দিবে না? মানুষটা হাতে থাকা ভাল।

পিসী তখন মোহরটি কুড়াইয়া লইয়া বলিল, “তার আশ্চর্যছ কি বাছা–তোমার মেয়ে মানুষ করিব, সে কি বড় ভারি কাজ? তুমি নিশ্চিন্তে থাক। আয় রে জান্ আয়!” বলিয়া পিসী কন্যাকে কোলে তুলিয়া লইল।

কন্যা সম্বন্ধে এইরূপ বন্দোবস্ত হইলে মাণিকলাল নিশ্চিন্তচিত্তে গ্রাম হইতে নির্গত হইল। কাহাকে কিছু না বলিয়া রূপনগরে যাইবার পার্বলত্যপথে আরোহণ করিল।

মাণিকলাল এইরূপ বিচার করিতেছিল,-“ঐ অধিত্যকায় অনেকগুলি অশ্বারোহী আসিয়াছিল কেন? ঐখানে রাণাও একাকী ভ্রমিতেছিলেন–কিন্তু উদয়পুর হইতে এত দূর রাণা একাকী আসিবার সম্ভাবনা নাই। অতএব উহারা রাণার সমভিব্যাহারী অশ্বারোহী। তার পর দেখা গেল, উহারা উত্তর হইতে আসিয়াছে–উদয়পুর অভিমুখে যাইতেছিল–বোধ হয়, রাণা মৃগয়া বা বনবিহারে গিয়া থাকিবেন–উদয়পুর ফিরিয়া যাইতেছিলেন। তার পর দেখিলাম, উহারা উদয়পুর যায় নাই। উত্তরমুখেই ফিরিয়াছে কেন? উত্তরে ত রূপনগর বটে। বোধ হয়, চঞ্চলকুমারীর পত্র পাইয়া রাণা অশ্বারোহী সৈন্য সমভিব্যাহারে তাহার নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছেন। তাহা যদি না গিয়া থাকেন, তবে তাঁহার রাজপুতপতি নাম মিথ্যা। আমি তাঁহার ভৃত্য–আমি তাঁহার কাছে যাইব–কিন্তু তাঁহারা অশ্বারোহনে গিয়াছেন–আমার পদব্রজে যাইতে অনেক বিলম্ব হইবে। তবে এক ভরসা, পার্বুত্য পথে অশ্ব তত দ্রুত যায় না এবং মাণিকলাল পদব্রজে বড় দ্রুতগামী |” মাণিকলাল দিবারাত্র পথ চলিতে লাগিল। যথাকালে সে রূপনগরে পৌঁছিল। পৌঁছিয়া দেখিল যে, রূপনগরে দুই সহস্র মোগল অশ্বারোহী আসিয়া শিবির করিয়াছে, কিন্তু রাজপুত সেনার কোন চিহ্ন দেখা যায় না। আরও শুনিল, পরদিন প্রভাতে মোগলেরা রাজকুমারীকে লইয়া যাইবে।

মাণিকলাল বুদ্ধিতে একটি ক্ষুদ্র সেনাপতি। রাজপুতগণের কোন সন্ধান না পাইয়া, কিছুই দু:খিত হইল না। মনে মনে বলিল, মোগল পারিবে না–কিন্তু আমি প্রভুর সন্ধান করিয়া লইব।

একজন নাগরিককে মাণিক বলিল, “আমাকে দিল্লী যাইবার পথ দেখাইয়া দিতে পার? আমি কিছু বখ‍‍শিশ দিব |” নাগরিক সম্মত হইয়া, কিছু দূর অগ্রসর হইয়া তাহাকে পথ দেখাইয়া দিল। মাণিকলাল পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করিল। পরে দিল্লীর পথে, চারিদিক ভাল করিয়া দেখিতে দেখিতে চলিল। মাণিকলাল স্থির করিয়াছিল যে, রাজপুত অশ্বারোহিগণ অবশ্য দিল্লীর পথে কোথাও লুকাইয়া আছে। প্রথমত: কিছু দূর পর্যহন্ত মাণিকলাল রাজপুতসেনার কোন চিহ্ন পাইল না। পরে এক স্থানে দেখিল, পথ অতি সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিল। দুই পার্শ্বে দুইটি পাহাড় উঠিয়া, প্রায় অর্ধিক্রোশ সমান্তরাল হইয়া চলিয়াছে–মধ্যে কেবল সঙ্কীর্ণ পথ। দক্ষিণ দিকের পর্বাত অতি উচ্চ–এবং দুরারোহণীয়–তাহার শিখরদেশ প্রায় পথের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। বাম দিকে পর্বতত, অতি ধীরে ধীরে উঠিয়াছে। আরোহণের সুবিধা, এবং পর্বিতও অনুচ্চ। এক স্থানে ঐ বাম দিকে একটি রন্ধ্র বাহির হইয়াছে, তাহা দিয়া একটু সূক্ষ্ম পথ আছে।